শীতের ছুটি মানেই তো পিকনিক নইলে ইতিউতি ঘুরতে বেড়নো। তা সেবার ঠাণ্ডাটা একটু জাঁকিয়ে বসতেই একদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। যার আঁকে-বাঁকে আর অলি-গলি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পুরনো গন্ধ। কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের হার না মানার গল্প তো কোথাও মাটিতে মিশে রয়েছে ঔপনিবেশিক কলোনি গড়ে ওঠার স্থাপত্য। আর সমস্ত কিছুর সাক্ষ্য নিয়ে আজও বয়ে চলেছে ভাগীরথী। তার জলে জমাট বেঁধেছে কত না অসহায়ের রক্ত যা আজ কালের স্রোতে মিলিয়ে যাওয়া ইতিহাস।
কুয়াশার চাদরে ঢাকা এক সকালে গাড়ি করে আমরা রওনা দিই মুর্শিদাবাদের প্রাণকেন্দ্র হাজারদুয়ারির পথে। শীতের সময় এখানে পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। প্রাসাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। অনলাইন টিকিট কেটে হাজারদুয়ারির প্রাসাদে প্রবেশ করতে হয়। বিশালাকার প্রাসাদটির সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমেই অভিভূত হয়ে গেছিলাম। আজও কত নবাব , ইংরেজদের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে তা ভাবলেই শিহরন জাগে। বর্তমানে এই প্রাসাদটি একটি মিউজিয়াম। নবাব সিরাজদৌল্লার মৃত্যুর আশি বছর পর নবাব হুমায়ূন জাঁ এটি নির্মাণ করান। ইউরোপীয় স্থাপত্যকলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তযুক্ত প্রাসাদটির প্রত্যেকটি ঘর অনুপম সৌন্দর্য্যের আলোকে সজ্জিত। বাংলার নবাব, অভিজাত এবং বৃটিশদের ব্যবহৃত নানা শৌখিন জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে এখানে। রয়েছে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র , তখনকার বাসনপত্র , আসবাব , শিল্পীদের আঁকা ছবি, পুঁথিপত্র এমন কত কী। সুরম্য বিশাল ঝাড়বাতি, যার নীচে সিংহাসনে বসে নবাব দরবার পরিচালনা করতেন। আর রয়েছে মহারানী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া রুপোর সিংহাসন। আসল-নকল মিলিয়ে প্রাসাদের হাজারটি দরজা। শোনা যায় নকল দরজাগুলি তৈরি করা হয়েছিল শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে। নবাবদের ঠাটবাট, জীবনযাপনের রকমসকম দেখতে দেখতে ইতিহাসের পাতায় বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হাজারদুয়ারি ছাড়াও এই এলাকায় দেখার মতো স্থাপত্যগুলি হল ইমামবাড়া, ঘড়িঘর, বাচ্চাওয়ালি কামান, মদিনা মসজিদ, চক মসজিদ।
সেই কবেকার কথা। বিশ্বাসঘাতকতার এক জীবন্ত ইতিহাস আজও যেন বয়ে বেড়ায় এখানকার আকাশে-বাতাসে, পথে-প্রান্তরে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল এক গভীর চক্রান্ত। যার ফল স্বরূপ পলাশীর যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন দুশো বছরের ইংরেজ রাজত্ব শুরু হয়। ঘৃণিত কলঙ্কজনক ষড়যন্ত্রের যে অধ্যায় রচিত হয়েছিল তার পিছনে ইংরেজদের সাথে জড়িত ছিল মীরজাফর , জগৎ শেঠ, ঘষেঠি বেগম , রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ। কলঙ্কিত সেই ইতিহাসের সাক্ষী মতিঝিল।
মতিঝিলে ছিল একটি প্রাসাদ এবং ঘোড়াকৃতি হ্রদ। প্রাসাদটি সিরাজের মাসি ঘষেঠি বেগমের। যা আজ ধ্বংসরূপে পরিণত হয়েছে। পলাশীর ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে এখানে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো হয়। একদিন যে প্রাসাদে বসে বাংলার বিরুদ্ধে, সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল আজ তারই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এই প্রজন্ম জানছে সেই ইতিহাস। মুর্শিদাবাদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছে কাঠগোলা বাগানবাড়ি। এখানকার প্রাসাদটি লক্ষ্মীপত সিং দুগার তৈরি। বর্তমানে এটি একটি সংগ্রহশালা। এখানে একটি জৈন মন্দির আছে। আছে আদিনাথের মন্দির। আদিনাথের মূর্তিটি অত্যন্ত প্রাচীন। মনে করা হয় নশো বছরের পুরনো। আর রয়েছে গুপ্ত সুড়ঙ্গ। যে সুড়ঙ্গ পথ নবাব থেকে ইংরেজ সকলেই একসময় ব্যবহার করতেন।
দুপুরের আহার সেরে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম কাটরা মসজিদের উদ্দেশ্যে। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে। আর তার লালচে ছোঁয়ায় মোহময়ী হয়ে উঠেছে মসজিদ। সেখানে পৌঁছে আমরা একজন গাইডকে সঙ্গে নিলাম। শুনলাম কবেকার সব কথা। ঢাকা থেকে রাজ্যপাট উঠিয়ে ভাগীরথীর তীরে মক্সুদাবাদে এসেছিলেন ঔরঙ্গজেবের দেওয়ান করতলব খান। খুশি হয়ে সম্রাট উপাধি দিলেন মুর্শিদকুলি। আর তার নাম অনুসারেই হল আজকের মুর্শিদাবাদ। যা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। এখানকার মসজিদেই তাঁর কবর রয়েছে। একসময় এই মসজিদে অনেকগুলি গম্বুজ ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মসজিদটির বিশাল চত্বরে একসঙ্গে দুহাজারজন প্রার্থনা করতেন। আশেপাশে আরও বেশকিছু দ্রষ্টব্য স্থান আছে যেগুলি টাঙ্গা অথবা টোটোয় চড়ে দেখে আসা যায়।
সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে জীর্ণ প্রাচীন ভগ্নপ্রায় সব বাড়ি। টাঙ্গায় চড়ে ফেরার পথে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে মনটা বড়ই উদাস হয়ে যাচ্ছিল। পুরনো স্থাপনার সব ইট, পাথর, খসে পরা পলেস্তারা, জং ধরা কার্নিশ, ভাঙা বারান্দা, ক্ষয়ে যাওয়া ছাদ সব জায়গায় আজও ইতিহাসের কত শত অজানা গল্প লুকিয়ে আছে, তারা যেন ফিসফিসিয়ে কথা কয়। আর তাই হয়তো ইতিহাসপ্রেমী মানুষ থেকে সাধারণ দর্শক সকলের কাছেই এই শহরের প্রতি টান আজও সমান। কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া জীবন্ত ইতিহাসের খোঁজে এখানে তাই বারবার ছুটে আসে মানুষ।