// তমলুকের সুপ্রাচীন ইতিহাসকথা ও ফুলের সাম্রাজ্য ক্ষীরাইয়ে নির্ভেজাল প্রকৃতির মাঝে//


       ভ্রমনপিপাসু মন হলে আর রক্ষে নেই, সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ে। এবার শীতের সময় আমার মেদিনীপুর যাওয়াটা যখন হলই তখন ফুলের উপত্যকা ক্ষীরাই দেখার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না। দূরপাল্লার ট্রেন ধরে ও পথ দিয়ে গেলেই  দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জোড়া রাশি রাশি ফুলের সম্ভার আমার মন টেনেছে সবসময়। প্রত্যেক ফুলপ্রেমীদের এলাকাটা যে আকৃষ্ট করবে এ বিষয়ে একদম নিশ্চিত। আর আমিও তাদের দলেরই একজন। তাই দুদিনের ছুটিতে ঐতিহাসিক বন্দর শহর তাম্রলিপ্ত ( বর্তমান নাম তমলুক ) ঘোরার সাথে একটা দিন ভোর ভোর দেখে ফুলের সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।

         তমলুক থেকে ক্ষীরাই এর দূরত্ব খুব বেশি নয়। দেড় ঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। ভোরের কুয়াশামাখা সকাল। এক বয়স্ক ঠাকুমা ফুলের তদারকি করছেন। তার যোগ্য নাতি কাজের লোকজন নিয়ে ব্যস্ত। সকালের ট্রেনে সেই ফুল যায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। আর রাজ্যের বাইরে যে সব ফুল বেচাকেনা হয় তা যায় গাড়ি করে। যখন পৌঁছলাম বেশ কিছু ফুলের তখন প্যাকিং চলছে। আমরা সাদা, গোলাপি, হলুদ চন্দ্রমল্লিকার মাঝে নিজেদের একসময় হারিয়ে ফেলি, সময়ের কোন হুঁশ থাকে না।

       মেদিনীপুরগামী ট্রেনেও ক্ষীরাই যাওয়া যায়। শীতের মরশুমে অনেকেই পিকনিকের জন্য এখানে আসেন। পথে চায়ের দোকানে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক তাদের দুদিন আগের পিকনিক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। আমরা তাঁর কথামতো নদীর ধার বরাবর গ্রাম্য মেঠো পথে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছেছিলাম।

      ক্ষীরাই এ বিভিন্ন রকমের ফুলের চাষ হয়। চারদিকে শুধু গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগঝুঁটি আরও কত নাম না জানা ফুল রয়েছে। বাড়ির মেয়ে-বউরাও গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে জমিতে লাগানো গাছগুলিকে যত্নআত্তি করে। চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলি বেশ বড় তাতে একটি কুঁড়ি রেখে বাকি সব ভেঙে ফেলছিল এক তরুণী। কথায় কথায় জানলাম তাতে ফুলটি নাকি আকারে অনেক বড় হয়ে থাকে। কাঁসাই ও ক্ষীরাই নদীর ধারে বিঘার পর বিঘা জমিতে সাধারণত সারাবছর ফুলের চাষ হয়। আর এখানকার ফুল চাষিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের ফুল বিক্রি করে থাকেন। ফুল চাষের জন্য মেদিনীপুরের এই অঞ্চল রাজ্য তথা দেশে আলাদা নাম করে নিয়েছে। এখানকার হরেক রকমের ফুলের সম্ভার সত্যিই মন মুগ্ধ করে। গ্রামের শান্ত নিবিড় পরিবেশ, পাখির কলতান সব মিলিয়ে একঘেয়ে জীবনে আলাদা স্বাদ এনে দেয়।

        যাইহোক ওখান থেকে ফেরার পর একটাদিন তমলুকে ঘুরলাম। এখানকার অন্যতম বিখ্যাত ও জাগ্রত দেবী হিসাবে স্বীকৃত বর্গভীমা । এই মন্দির শুধু তমলুকে নয় পার্শ্ববর্তী বহুদূর বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষের কাছেই জাগ্রত দেবী হিসাবে পূজিত হন। বর্গভীমার মন্দিরটি পূর্বে বৌদ্ধ মন্দির ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণদের দ্বারা এটি হিন্দুমন্দিরে রূপান্তরিত হয়। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক কিন্তু এটিকে বৌদ্ধ মন্দির বলে স্বীকার করেন না। মন্দিরটি কবে নির্মিত হয় সে বিষয়ে ও কিছু জানা যায় না। অবশ্য অনেকে মনে করেন ময়ূরবংশীয় রাজা স্বয়ং তাম্রধ্বজই এই দেবীমূর্তি ও মন্দিরের এর প্রতিষ্ঠাতা। তবে সম্ভবত মন্দিরটি পালরাজাদের সময় বা তার পরে নির্মিত হয়। মন্দিরটি নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। বলা হয় একান্ন পিঠের অন্তভুক্ত সতীর বাঁ পায়ের গোঁড়ালি পড়েছিল এখানে। কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত দেবী উগ্রতারা রূপে পূজিত হন। দেবীর ধ্যান ও পূজাদি যোগিনী মন্ত্র ও নীলতন্ত্রানুসারে সম্পাদিত হয়। তবে ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ রচয়িতা যোগেশচন্দ্র বসু মন্দিরটিকে একান্নপিঠ হিসাবে মনে করেন না।  মন্দির চত্বরে রয়েছে বহু পুরনো চাঁপা, গুলঞ্চ, কেলিকদম্ব বৃক্ষ। বার বার সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের থেকে রক্ষা করার জন্যই বোধহয় মন্দিরটি এতো উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ঝড়-বন্যায় বহুসহস্র শহরবাসী এখানে আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল বলে জানা যায়।

         কথিত আছে তমলুকে একদা ‘কপালমোচন’, নামে এক তীর্থক্ষেত্র ছিল যা রূপনারায়ণের গর্ভে বিলীন হয়েছে। আজও প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিনে তমলুকের শঙ্করআড়া খালে এবং নিকটস্থ ‘কপালমোচন’ তীর্থরূপে চিহ্নিত বাঁধানো পুকুরে স্নান করে ভক্তরা পুণ্যার্জন করেন।

         বর্তমানের তমলুকই প্রাচীনকালের আন্তর্জাতিক তাম্রলিপ্ত বন্দর শহর। এর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে রূপনারায়ণ নদী এবং পশ্চিমে সুবর্ণরেখা দ্বারা শহরটি বেষ্টিত ছিল। পুরাণ, মহাভারত, দশকুমারচরিতে এই তাম্রলিপ্ত পরিচিত ছিল তমালিকা বা তমলিতি নাম । ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙের বিবরণীতেও এই বন্দরের কথা পাওয়া যায়। কথিত আছে বেহুলা মৃত লখিন্দরকে নিয়ে নদীপথে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। অতি প্রাচীন জনপদটির বয়স প্রায় পাঁচ হাজার বছর।

         তাম্রলিপ্ত শব্দের অর্থ তামায় মোড়া। ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলায় রয়েছে তামার খনি। ওই খনি থেকে তামা উত্তোলনের পর এই বন্দর দিয়েই রপ্তানি করা হতো। একসময় রোম, গ্রীস, মিশর, চিন, শ্রীলঙ্কা, জাভা ইত্যাদি স্থানে নীল, রেশম রপ্তানী হত নিয়মিত। বানিজ্যক সুবিধার্থে পাটলিপুত্র থেকে তমলুক পর্যন্ত রাজপথও বানানো হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হওয়ার পাশাপাশি তাম্রলিপ্ত ছিল তৎকালীন বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার পীঠস্থান। বৌদ্ধধর্ম প্রসারের জন্যও বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকরা এই পথ ব্যবহার করতেন।

        তমলুক রাজবাড়ির ইতিহাসও নেহাত কম দিনের নয়। মহাভারতে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায় তমলুকের রাজাদের কথা পাওয়া যায়। ময়ূরবংশীয় রাজাদের রাজধানী বিস্তৃত ছিল আটমাইল পর্যন্ত। বর্তমানে যেটি রয়েছে তা সম্ভবতঃ কৈবর্ত রাজাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই রাজবাড়ির যে অবদান তা অনস্বীকার্য। লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে এই রাজবাড়িতে সত্যাগ্রহীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নজরুল ও সুভাষচন্দ্র বসু এখানে এসেছিলেন। রাজবাড়ি সংলগ্ন যে আমবাগান সেখানে নেতাজী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমরা যে সময় ওখানে গেছিলাম তখন কৃষি ও কুটির শিল্পমেলা চলছিল। আর তিনদিনব্যাপী রাজবাড়ি সংলগ্ন রাধামাধব মন্দিরে ওয়াল্ড হিস্ট্রি রিসার্চ অ্যাকাডেমির ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার চলছিল। যা বসে দেখার বা শোনার ইচ্ছে থাকলেও আমরা সময় করে উঠতে পারিনি।

        বর্তমানে তমলুক তথা তাম্রলিপ্তের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের আজ সামান্য কিছু নিদর্শনই স্থানীয় মিউজিয়ামে পাওয়া যায়। অতীতের সমস্ত অহংকার এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে শহরের আনাচে-কানাচেয়। আর গৌরবময় ইতিহাসের এই যে বিস্মরণ তা সত্যিই বড় বেদনার।

     তথ্য – বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস – যুধিষ্ঠির জানা,  উইকিপিডিয়া

কুহেলী বন্দ্যোপাধ্যায়

,

2 responses to “// তমলুকের সুপ্রাচীন ইতিহাসকথা ও ফুলের সাম্রাজ্য ক্ষীরাইয়ে নির্ভেজাল প্রকৃতির মাঝে//”

  1. Its like you read my thoughts! You appear to grasp so much about this, such as you wrote the ebook in it or something.
    I believe that you just can do with a few % to force the message home a little
    bit, but instead of that, this is excellent blog. A fantastic read.
    I will definitely be back.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *