বাহন কথা


                          কুহেলী ব্যানার্জী

    

  মোগাম্বো খুশ হুয়া ( পর্ব – ৪)

 মিটিং বসেছে দেবদেবীর সব বাহনদের। বনের এক প্রান্তে সকলে তারা নেমে এসে একত্রিত হয়েছে। আজকাল মর্তের মানুষদের তারা নিজেদের অভাব-অভিযোগ, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা নিয়ে নানারকম মিটিং-মিছিল করতে দেখেছে। তাই তারাও এমনই একটা মিটিং করার প্ল্যান বেশ কিছুদিন থেকেই করছিল। এমনিতে মাঝে মধ্যেই দেখা সাক্ষাৎ হলে  নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলে ভাগাভাগি করে নেয় ঠিকই তবে সমস্যার সুরাহা তো তাতে হয় না। আর স্বর্গে দেবতাদের কাছে তাদের এইসব সুবিধা-অসুবিধার কথা বললে সবসময় তাঁরাও অতটা গা করেন না। অগত্যা নিজেদের কষ্টের লাঘব করতে শেষে এই পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে তাদের।

     

মিটিং এ পশুপাখিরা সকলে এক এক করে নিজস্ব সমস্যা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে মা লক্ষীর বাহন প্যাঁচা বলে উঠলো এই তো আমি পুজোর দিনটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারারাত না ঘুমিয়ে মায়ের সাথে হাজির হলাম মর্তে। কি না মর্তবাসীর সুখ-শান্তি আর ধনসম্পত্তির বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু…

      

  ইঁদুরও ওদিক থেকে হাঁ হাঁ করে চিৎকার জুড়লো। বলল, প্রভুর সাথে মর্তে গিয়ে আমি তো টিকতেই পারি না, মর্তবাসীরা সব এত জোরে গান লাগায়! যে বক্সের আওয়াজে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়। এইতো যাবার আগে বললাম এবারটা না হয় ছেড়েই দেন প্রভু, নাইবা গেলেন ! কিন্তু প্রভুর কি সে উপায় আছে? তিনি যে বিঘ্নহরতা। সকলের শুভ করেন, মঙ্গল করেন। তাই তো মর্তবাসী যাই করুক না কেন তাকে  আসতেই হয়।

     

প্যাঁচা আবার বলে উঠলো মাতাও আজকাল যে বাড়িতে যত ভালো আয়োজন সেখানেই যাচ্ছেন এবং থাকছেন। দেবতার কাছে ভক্তির বদলে কি আচার-অনুষ্ঠানই বড় হয়ে উঠেছে আজকাল ? ব্রতকথার গল্পে যেভাবে আমার গরীব রাখাল ছেলেকে তিল-ধুবড়ী দিয়ে উপকারের কথা আছে তা এককালে হয়ে থাকলেও আজ যেন সব উলট পুরাণ। মা না জানি কেমন হয়ে গেছেন! যুগের হাওয়া বোধহয় দেবদেবীদের অন্তরাত্মাও ছুঁয়ে ফেলছে । তাই তাঁরা পরিবর্তিত হচ্ছেন। দয়া করলেও স্থান-কাল-পাত্র আর দেখছেন কই ! কি জানি মায়ের লীলা মা নিজেই জানেন।

     

  এরপর  শিয়ালও খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠলো আমি আর মায়ের বাহন হয়ে থাকতে চাই না। মা আগে এত রাক্ষস-দত্যি-দানবদের বধ করেছেন যে বলার নয়। কিন্তু আজকাল মা আর অস্ত্র ধরেন না, বধও করেন না। তাই তো চারিদিকে এত অন্যায়-অবিচার।

       

অন্যদিকে সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস গর্বের সঙ্গে বলে উঠলো এ বিষয়ে আমার মা কিন্তু চরম সজাগ।  তিনি কিন্তু সহজে সকলের ওপর তার কৃপা দৃষ্টি দেন না। পরিশ্রম, চেষ্টা আর মনোযোগের মাধ্যমেই তাকে লাভ করা যায়।

        

 মা ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল দুঃখ করে বলল মর্তবাসী সারা জীবন শুধু আমাকে অপয়া বলেই দেখে গেল। এ কেমন কথা জগৎপিতা তো সকলের সৃষ্টি কর্তা । তবে আমাকে কি তিনিও এমন ভাবেন ? নাকি এ শুধুমাত্র মর্তবাসীরই ভাবনা ? নইলে মর্তের কোন কোন দেশের সংস্কৃতিতে আমি তো পূজিতা হয়ে আসছি সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে। আমরা তো সকলেই ঈশ্বরের তৈরি, তবে প্রভুরা কেন আমার প্রতি এমন অন্যায়ের বিচার করবেন না ?              

         

   এদিকে দেবাদিদেবের  বাহন নন্দী তখন বলে উঠল বাবা তো ধ্যানেই মগ্ন থাকেন। কিন্তু আমি কি করি ! পুজোর দিনে মর্তবাসীরা আমার  যা শোচনীয় অবস্থা করে তোলে তা আর বলার কথা নয়। দুধ-গঙ্গাজল আর ফুলে ঢেকে যায় আমি। ভক্তের ভক্তি তো দেবাদিদেব মানতেই পারেন কিন্তু এ যে অতি ভক্তি চোরের লক্ষনে গিয়ে ঠেকছে ভাই!           

      

 এরপর এক এক করে হাতি, বাঘ, সিংহ, ময়ূর, কুকুর, হরিণ, ঘোড়া সকলেই নিজেদের কথা বলতে থাকল। তাদের উদ্দেশ্য কৈলাসে আলোচনাটা পশুপতিনাথের কাছে পোঁছানো। যাতে  তিনি যেন করুণাময় রূপে আবির্ভূত হয়ে সকলের অসুবিধা, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা দূর করেন। 

 

****************************************************          

      

  এদিকে  বনের পথ ধরে মোগাম্বো যেতে যেতে সব দেখেশুনে ওর তো চক্ষু ছানাবড়া। তবে দেবতাদের বাহনদের কথাগুলো যে মোটেও ফেলে দেওয়ার মতো নয় এটা মানতেই হবে। এ যেন সমস্ত পশুপাখিদের অন্তরেরই কথা তাদের মুখে সে শুনতে পেল। পুজোর ছুটিতে বেড়াতে এসে এবার এটা দারুণ অভিজ্ঞতা হল ওর। ভাবা যায়! সব দেবতার বাহনদের দেখা পাওয়া। সে কি চাট্টিখানি কথা? সিতারা, ঘন্টিলালরা সবাই শুনে নিশ্চয় থ হয়ে যাবে। কথাটা মনে হতেই বেশ একটা জোশ আসে মোগাম্বোর। পরদিন সকালে আবার ওদের ট্রেনে ফেরা। তাই  আর না ঘুরেফিরে সে গেস্টহাউসের দিকে পা বাড়ায়।