আমাদের বাঙালীদের জাতীয় উৎসব দুর্গাপুজো আর রাঢ়বঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের জাতীয় উৎসব হল টুসু পরব । তবে এই পরবের ব্যাপ্তি অবশ্য বিহার, ঝাড়খণ্ডেও। রাঢ়বঙ্গের গ্রামবাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে টুসু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকলেও বর্তমানে তা শহুরে জীবনে যে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে তা কংসাবতী নদীর সেতুর ভিড় দেখে বোঝা গেল। মকরসংক্রান্তির দিন পুরুলিয়া শহর লাগোয়া নদীতে ভিড় ছিল দেখার মতো। এই সময় গোটা শহর জুড়েই সমস্ত দোকানপাট অলিখিতভাবে বন্ধ থাকে।
আগেরদিন দুপুর নাগাদ সার্কিট হাউসে পৌঁছেই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম গ্রাম্য হাটের উদ্দেশ্যে। আমরা অর্থাৎ অয়নদা, শুভদা , চন্দ্রানীদি আর আমি। শাল-পিয়াল-পলাশ বনের গা লাগোয়া মাঠে হাট বসেছে। সব্জি-ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসেছে হাটুরেরা। বিভিন্ন রঙ আর আকৃতির টুসুর চৌডল বিকিকিনি চলছে। কেউ কেউ ওখানে বসেই চৌডল তৈরিও করছে। দেখে মনে হচ্ছে পুরো হাট জুড়ে ঠিক যেন রঙের মেলা বসেছে। দূর দূর গ্রাম থেকে দলবেঁধে মেয়ে-বউরা হাটে চলেছে। হাট থেকে ভেসে আসা ধামসা-মাদলের বোল বাজছে দিদিম দিদিম। তারপর দিনান্তে রাঙা পথ ধরে টুসু গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে। সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্খায় মোড়া মায়ামাখা গানগুলির সুরের জাদু দূর থেকে আরও দূরে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে । সন্ধ্যার সেই মায়াবী আলো আঁধারী পরিবেশে ধুলোয় ভরা মেঠো পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়।
টুসু কোন পৌরাণিক দেবী নন। তিনি লৌকিক দেবী। এই পরবে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে আদিবাসী মানুষের প্রানের স্বতোৎসারিত আনন্দ যেভাবে প্রকাশিত হয়, তা আর অন্য কোন পরবে হয় না। এই সময় সকলে বাড়ি ফেরে, নতুন জামা পরে, পিঠে-মাংস ভাতে মেতে ওঠে। তবে ধর্মের ছোঁয়া থাকলেও এই উৎসব একান্তই সাধারন মানুষের হৃদয় বন্ধনে আবদ্ধ। এর উৎসবও সার্বজনীন। এর সার্বজনীনতার শিকড় জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে, চাষ-আবাদের সাথে। কৃষির উন্নতির জন্য, ভালো ফলনের জন্য টুসুর কাছে প্রার্থনা জানানো হয়। এককথায় উর্বরাশক্তির উপাসনা করা হয়। গ্রামীণ সমাজের এই কৃষি উৎসবের উপাসনা কুমারী তথা নারী সম্প্রদায়ই করে থাকে। আর আদিবাসী সমাজের উর্বরা শক্তির উপাসনার এই যে ধর্মাচরণ ও ধর্মভাবনায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তা সম্ভবত আদিমযুগে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা যে নারীর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল তাকেই ইঙ্গিত করে।
ঘর গেরস্থালির নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র ও বনজঙ্গলের আদিম পারিপার্শ্বিকতা থেকে লৌকিকদেবদেবী জন্ম নিয়েছে বলে মনে করা হয়। গপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু তাঁর ‘’বাংলার লৌকিক দেবতা’’ গ্রন্থে টুসুকে স্বমহিমায় স্থান দিয়েছেন। গবেষক বিনয় মাহাতো মনে করেন টুসু শব্দটি ধানের খোসা তুস থেকে উৎপন্ন। এই তুস মৃত ধানের প্রতীক। আর টুসুকে জলাশয়ে বিসর্জনের অর্থ হল মৃত শষ্যকে কবর দেওয়া। মৃত শষ্যকে কবর দেওয়ার অনুষ্ঠান হলেও টুসু উৎসব কখনই শোকৎসব নয় বরং মৃতের অবশ্যম্ভাবী পুনর্জন্মকে ত্বরান্বিত করার জন্য জাদুক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আনন্দোৎসব। গোবর পিটুলিগোলা প্রভৃতি উর্বরতাজ্ঞাপক ইন্দ্রজালিক উপকরনের মাধ্যমে ধরিত্রীর উর্বরাশক্তিকে বৃদ্ধি করে মৃত শষ্যের পুনর্জন্মকে ত্বরান্বিত করার কৌশল বলে মনে করা হয়। মূলত আদিমমানুষ প্রকৃতিতে বিচিত্রলীলার প্রকাশ দেখতো। জন্মমৃত্যুর যে চক্র তা বৃক্ষলতাগুল্মর মধ্যেও দেখতে পেয়ে পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতো। তাই তারা মৃত্যু সম্পর্কিত উৎসবেও জীবনের জয়গান গাইত। টুসুর ধর্মভাবনার মূল মহাবাণীও জীবনের জয়গান গাওয়া।
টুসুকে নিয়ে বিভিন্ন লোককথা প্রচলিত থাকলেও বিভিন্ন গবেষক সেগুলিকে আমল দিতে চাননি। কুমারী রূপে পূজিত এই লৌকিকদেবীর মূলত কোন মূর্তি প্রচলন নেই। তবে কোন কোন স্থানে টুসুর মূর্তি পূজা হয়ে থাকে। শাস্ত্রীয় দেবী লক্ষ্মীর মতই টুসুরও হলদে রঙ, মাথায় রাংতার মুকুট, দুই হাতে পদ্ম এবং অলঙ্কারে সজ্জিতা। এর প্রথামতো কোন পুজো হয় না, পূজোর যাজকও মেয়েরাই। টুসু গানই এই পরবের একমাত্র মন্ত্র। স্থাপন, পালন, জাগরণ ও বিসর্জন এই চারটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে একমাস ধরে পুজো চলে। অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে টুসুকে বাড়ির উঠানে আলপনা এঁকে স্থাপন করা হয়। সাধারণত প্রদীপ সজ্জিত একটি মাটির সরায় তুষ-তুষালি আর ফুল সাজিয়ে প্রতি রাতে পুজা করা হয়, দিনে এর পুজা হয় না। এই মাটির সরাকে স্থানীয় ভাষায় টুসু খোলা বলে। পুজার সামগ্রী চিঁড়ে, গুড়, মুড়ি, মণ্ডা। রাত জেগে টুসু্কে সাজিয়ে পালাগান চলে। রঙিন কাগজে বাঁশ দিয়ে টুসু তৈরি করা হয় । পৌষ সংক্রান্তিতে এর বিসর্জন দেওয়া হয়। ওই দিন স্থানীয় নদী জলাশয়গুলো হয়ে ওঠে বর্ণময়।
পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় টুসু উপলক্ষে মেলা বসে। জয়পুরের কাছে পুরাতাত্ত্বিকক্ষেত্র দেউলঘাটার টুসু ভাসান সত্যিই দেখার মতো। পরদিন সকালে আমরা সেখানে হাজির হলাম। এখানকার প্রাচীন মন্দিরগুলি এগারো শতকে রাজা অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদেবের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত । দুটি মন্দির এখনো অক্ষত থাকলেও বাকিগুলি ধংস প্রাপ্ত হয়েছে। মন্দিরের ইঁটের দেওয়ালে সূক্ষ্ম স্টাকোর কারুকার্য এবং প্রবেশ দ্বারে ত্রিকোণ করবেল মুগ্ধ করে। মন্দির দুটিতে অবস্থিত শিবলিঙ্গে দূরদূরান্ত থেকে আসা গ্রাম্য মেয়ে-বউ-বৃদ্ধা সকলেই কংসাবতীতে স্নান করে জল অর্পন করে।
টাঁড়-ডুংরি পেরিয়ে, পায়ের পাতা ডোবা ধুলো বাতাসে উড়িয়ে উঁচু-নিচু আলের পথ ভেঙে লাল-নীল-হলদে-সবজে রঙা শাড়ি জামাপরা মেয়েরা দলবেঁধে চৌডল মাথায় নিয়ে গান গাইতে গাইতে নদীর দিকে আসতে থাকল। সে এক অনুপম চিত্তহরণকারী দৃশ্য। সুন্দর কারুকার্য করা বিচিত্র বর্ণে সাজানো টুসু চৌডলগুলি অতীব সুন্দর। নদীর পা ভেজানো জলে এরপর সারাদিন ধরে হাসি ঠাট্টার মাঝেই গান গেয়ে টুসু ভাসানো চলে। এই টুসু গানের পরতে পরতে ধরা পড়ে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি থেকে বর্তমান সমাজের বাস্তবচিত্র। এদিকে ধীরে ধীরে দেউলের আশেপাশে বসা মেলায় ভিড়ও ক্রমশ বাড়তে থাকলো। তবে সেই গ্রাম্য মেলায় শহুরে আভিজাত্য নেই ঠিকই কিন্তু মিলনৎসবের এক স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস আর দুর্দম প্রাণস্পন্দন রয়েছে। যা আমাদের মতো ছাপোষা বাঙালির দশটা-পাঁচটার জীবনে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
এই লৌকিক দেবীর আবির্ভাব এবং তাঁকে ঘিরে যে এই উৎসব জঙ্গলমহলে কবে থেকে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে সমগ্র একটি জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান, জীবনযাপনশৈলীকে কেন্দ্র করে যে লোকসংস্কৃতি গড়ে ওঠা তা অবশ্যই দীর্ঘকাল ধরেই ঘটেছে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলেই এমন বহু সংস্কৃতির সন্ধান মেলে যা সমগ্র বাংলার অহংকার। টুসুও ভাদু, ঝুমুর, মনসার গানের ন্যায় লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডারকে বৈচিত্রের পূর্ণতা দিয়েছে। তাই এই ডিজিটালের যুগে এইসব লোকসংস্কৃতিগুলি যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
কুহেলী বন্দ্যোপাধ্যায়
One response to “ভ্রমণ// মকরসংক্রান্তিতে পুরুলিয়ায় টুসু পরব”
খুব ভাল। অনেক অজানা তথ্য জানা গেল ।