চিরকালীন এক অপার বিস্ময়ে মোড়া সুন্দরবন, বৈচিত্রের আঙিনায় যেখানে ভিড় করে আতঙ্ক আর কৌতূহল, তাকে ঘিরে জানার শেষ নেই, অন্তহীন সে পথের গায়ে গায়েই লেগে থাকে অর্বুদ জিজ্ঞাসা। আর সেই জিজ্ঞাসাই জন্ম দেয় সাহিত্যের আকর। বিভূতিভূষণ সুন্দরবন কে নিয়ে তাঁর ‘’ সুন্দরবনে সাত বছর ‘’ উপন্যাসে সেখানকার জলদস্যু ও ডাকাতদের কথা বলেছেন। আবার বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা উপন্যাসে দেখা যায় নবকুমার সুন্দরবনের একদিকে সমুদ্র, স্বাপদসংকুল অরণ্য ও অন্যদিকে মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো ছোট-বড় অজস্র সমুদ্র অভিমুখী নদ-নদীর বিচিত্র মনমুগ্ধকর রূপ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য সেকালের সাথে একালের সুন্দরবনের বিস্তর ফারাক।
এই জল জঙ্গলের দেশের বাসিন্দাদের বরাবর প্রতিনিয়ত বাঘ, কুমির আর প্রকৃতির ভয়াল দুর্যোগের সাথে লড়ে টিকে থাকতে হয়েছে । তারা জঙ্গলের কাঠ, মধু, ফল, নদীর মাছ, কাঁকড়া আর চিংড়ি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। খুব কম চাহিদা নিয়েই তারা তাদের অস্ত্বিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সেই সুদুরকাল থেকে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, এই সুন্দরবন চিরকাল এমন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল না। একসময় সেখানে কোলাহল মুখর জনবসতি ছিল । নদীনালা ধরে চলতো দেশের অন্তঃবানিজ্য ও বহির্বাণিজ্য । পাল, সেন কিংবা গুপ্ত যুগ থেকে বারে বারে সমুদ্রের বুকে বিলীন হওয়ায় এর সমৃদ্ধি ব্যহত হয়েছে। তবে এই সুন্দরবন যে অতি প্রাচীন একটি গাঙ্গেয় বদ্বীপ তা রামায়ণ , মহাভারত , পুরাণ এমন কি শ্রীমদ্ভাগবতেও বর্ণীত আছে। সাগরদ্বীপে অবস্থিত সাংখ্য প্রণেতা বৈদিক ঋষি কপিলমুনির আশ্রম তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব ও শৈব সম্প্রদায়ের প্রভাব যে একসময় বেশি ছিল তা ভূগর্ভ খনন করে পাওয়া বিভিন্ন মূর্তি থেকে জানা যায়।
সুন্দরী গাছের আধিপত্য থাকায় এই অঞ্চলের নাম সুন্দরবন হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে ‘সমুদ্রবন’ থেকে কালক্রমে তা অপভ্রংশের মধ্যে দিয়ে সুন্দরবন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার অনেকে মনে করেন চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের শাসনাধীন থাকায় এই অঞ্চলের এই রূপ নাম হয়েছে। প্রাচীন ইতিহাসবিদরা মনে করেন সুন্দরবনের আর এক নাম ‘গঙ্গারিডি’ ছিল। ভারত ভ্রমণ প্রসঙ্গে হিউয়েন সাং, মেগাস্থিনিস এই ‘গঙ্গারিডি’ অঞ্চলের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে বারবার এই অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মুঘলদের শাসনকালে জনবসতি স্থাপিত হলেও ইংরেজ রাজত্বকালে এখানকার মানচিত্র তৈরি হয়েছিল।
বঙ্গোপসাগর প্লাবিত স্বাপদশঙ্কুলে ভরা নোনা জল, মাটি ও লবনাম্বুবৃক্ষে ঘেরা সুন্দরবন বদ্বীপের নিরন্ধ্র অরণ্যের বুকে রয়েছে বিশ্বের বিস্ময় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজকীয় উপস্থিতি । সুন্দরবন একাধারে সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ইকসিস্টেম, জাতীয় উদ্যান এবং সর্বোপরি বায়োস্ফিয়ার রিসার্ভ ফরেস্ট। আর এখানে পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের আসার পিছনে মূল আকর্ষণ যে বনের রাজা সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরাও ওই একই উদ্দেশ্যে নভেম্বরের মাঝামাঝি এই টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। হাওড়া থেকে গদখালি পর্যন্ত আমাদের ট্যাক্সি করা ছিল । স্টেশনে কুলিদের সঙ্গে যুদ্ধ এবং সন্ধির যে অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল তার সঙ্গে আমি খুব একটা পরিচিত নই, আসলে চিরকাল নিজের গন্ধমাদন নিজেই বয়ে নেওয়ার অভ্যেস। তাই সমস্ত ব্যাপারটাই আমার সঙ্গে থাকা দিদি সামলালো। এ প্রসঙ্গে বলে নিই যে আমাদের এই জার্নিতে পাঁচজনের টিমে চারজন মেয়ে আর একজন ভাই ছিল। তবে আমাদের ‘Woman gang’ আগেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। গদখালি ফেরিঘাটে সুবলদা (বোটম্যান) বাবা সনাতনকে নিয়ে হাজির ছিল আমাদের জন্য । সাগর ( সুবলদার ছেলে ) আমাদের লাগেজ বোটে উঠিয়ে নিলে বালি আইল্যান্ড (Bali Island) এর দিকে রওনা দিলাম, যা কিনা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গোসাবা ব্লক (Gosaba block) এর অন্তর্গত।
ইউনেস্কো কতৃক ঘোষিত এই World Heritaze অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান যথেষ্ট জটিল। এখানকার নদীগুলো মিঠে ও নোনা জলের মিলনস্থল। নিওটেক্টনিক গতির কারনে মিষ্টি জলের বৃহত্তর ধারা বাংলাদেশের সুন্দরবনে প্রবাহিত হয়েছে। আর তাই ভারতের তুলনায় সে দেশের জলের লবণাক্ততা অনেক কম।
আমাদের রাত্রেই শুধুমাত্র হোটেলে বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল। সারাদিনমান বোটেই থাকা – খাওয়া, তাই সঙ্গে টুকটাক কিছু জিনিসপত্র নিয়ে দুর্গাদোয়ানি ঘাট থেকে আমরা ভোর ৫টা নাগাদ বেড়িয়ে পড়ি। কুয়াশামাখা ভোরের আবছা আলোয় নৌকো এগিয়ে যেতে থাকলে দু – একটা জেলে মাঝিদের বোট চোখে পড়লো। গভীর বনে জেলেদের ঢোকার পারমিশন নেই। সজনেখালির দিকটায় ফিশিং হয়ে থাকে বলে জানালো রামকৃষ্ণদা ( গাইড )। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বিদ্যাধরীর জলরাশি ঠিক যেন গলে যাওয়া সোনায় পরিবর্তিত হল। দূরের ভাসমান নৌকা ; সুন্দরী , গরান ,হেতালের ঘন বনানীও সোনালী সূর্যের আভায় যেন জেগে উঠলো। সারা বনময় তখন কত অজানা পাখিদের আনাগোনা।
আমরা পঞ্চমুখানীর দিকে এগোতে থাকলাম। সেখানকার অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। দোবাঙ্কির পর মোবাইলের সিগন্যাল ঠিকমত পাওয়া যায় না। প্রকৃতির এক অনন্য রূপে ভরা এই সুন্দরবনের জীববিচিত্রও নেহাত কম নয়। সুধন্যখালির কাছে পৌঁছে হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির বক এবং পাখি নজরে এল। মরা কোটালের সময় চরের বেশ খানিকটা জেগে থাকায় ইতিউতি স্যান্ডপাইপার আর কারলিউ অবাধে চড়ে বেড়াচ্ছিল। একটা কুমীরকে দেখলাম বেশ আয়েশ করে শুয়ে আছে। তবে স্যান্ডপাইপারের এর অদ্ভুত ডাকের সাথে তার নাচটাও ক্যামেরা বন্দি করার মতোই সুন্দর।
আর আমার জার্নিটা যেহেতু পাখিপ্রেমী দিদিদের সাথে শুরু হয়েছিল তাই তাদের কাছ থেকে Bird Photography-র বিষয়ে শেখাটাও পুরো ভ্রমণ জুড়েই চলছিল। আমরা ব্রাহ্মণী কাইট, বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, চিত্রা হরিণের দল, বানর, বনমোরগ, শুকর, পেরিগ্রিন ফ্যালকন, মনিটর লিজার্ড ইত্যাদি দেখতে দেখতেই এগোচ্ছিলাম। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত জলরাশি, ছোট ছোট খাঁড়ি, নদীর চড়ে জেগে থাকা শ্বাসমূল , বকেদের নিজকর্মে ধ্যানমগ্নতা সবটাই ছিল উপভোগ করার মতো। আর এই সব মিলিয়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রথমদিনটা আমার জন্য মোটেও মন্দ ছিল না। যাইহোক সেদিনটা আমাদের সকলকে পাগ মার্ক দেখেই ক্ষান্ত হতে হল ।
পরদিন জানা গেল গতকাল বাঘের কোন মুভমেন্ট লক্ষ্য করা যায় নি, গতপরশু বাঘকে যেখানে দেখা গেছিল আজও সেখানেই আছে। আমাদের বোটও সেইমতো পিরখালী ৫ আর ৬ এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে থাকলো। সকলে যখন মহারাজের দর্শনের আশায় অধীরভাবে অপেক্ষমান তখন আমি চোখ বোলাতে থাকলাম সুন্দরবনের অজানা লোকসাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায়।
বর্তমানে সুন্দরবনের স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও জলপ্লাবমান উপকূলবর্তী গাঙ্গেয় অঞ্চলের অধিকাংশ বদ্বীপই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই সেখানকার সাহিত্য, সংস্কৃতি যে লৌকিক হবে তা বলাই বাহুল্য। এই সকল অঞ্চলে যে সব গান প্রচলিত আছে তা গাজী সাহেবের এবং বনবিবির গান নামে পরিচিত। এঁদের নিয়ে যে সব পালাগান রচিত হয়েছে তা বাউল্যা, মউল্যা, মলঙ্গি প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষেরা ভক্তিভরে শ্রবণ করে থাকে। বড় গাজি খাঁ, দক্ষিণ রায়, বনবিবি, আটেশ্বর, কালু রায়, ওলা বিবি এরা সকলেই সর্বজনীন শ্রদ্ধেয় দেবদেবী। তবে এরা কেও কল্পিত নয়, সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ ও নারী । অপূর্ব ক্ষমতা বলে দেবতা তুল্য হয়েছেন। এঁদের নিয়ে জহুরানামা, রায়মঙ্গল ইত্যাদি কাব্য রচিত হয়েছে। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে প্রখ্যাত মনিষী বিনয় ঘোষ এই সকল লৌকিক দেবতাদের পুজো সুন্দরবনের সংস্কৃতির একটি বিরাট অধ্যায় জুড়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন । তাঁর ভাষায় ‘‘দক্ষিণের কথা দক্ষিণ রায় কে বাদ দিয়ে বলা যায় না, বলা সঙ্গতও নয়। দক্ষিণ রায় মানুষ নন, দেবতা এবং শুধু দেবতা নন, বাঘের দেবতা । বাঘের দেবতা অর্থে ব্যাঘ্ররূপী দেবতা নন। বাঘের উপর আধিপত্য যাঁর বেশি, তিনিই বাঘের দেবতারূপে কল্পিত দক্ষিণ রায়’’। যিনি ষোড়শ শতকের শেষভাগে বা সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে সুন্দরবনে রাজত্ব করতেন বলে মনে করা হয়।
ব্যাঘ্রদেবতা হিসাবে দক্ষিণ রায়ের ন্যায় বনবিবিকেও হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জনগণই অদ্যাবধি বিশেষ শ্রদ্ধা সহকারে পুজো করে আসছে। পৌষ সংক্রান্তির পরদিন এখানকার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে বনবিবির পুজো হয়। জোয়ার শুরুর পরে ভাটা শেষে ফের নদীতে জোয়ার লাগা কে এক ভাটি বলা হয়। কথিত আছে, আঠারো ভাটির সময়ে কেউ যদি জঙ্গলে গিয়ে মাছ, কাঁকড়া ধরে কিংবা মধু-কাঠ ভাঙে তাহলে তাকে দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে স্বয়ং দেবী রক্ষা করেন। বহু বছর থেকে এই বিশ্বাস আঁকড়ে আজও মানুষজন জলজঙ্গলে তাঁর নাম করেই যায়।
যাইহোক দীর্ঘ সময় ধরে পিরখালী ৫ ও ৬ এর এলাকায় আমাদের বোট ঘোরাঘুরির পর সকলে যখন লাঞ্চ করে নেওয়ার কথা ভাবছি তখন দূরে বেশ কিছু বোট দেখা গেল। আমাদের পিছনে থাকা দুটো বোটকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে দেখলাম। সকলেই সেসময় বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি । এমন ধরনের অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। বোটে বোটে বেস্ট পজিশনের জন্য ঠোকাঠুকি লেগে গেল। কয়েকটা বোটের ফটোগ্রাফারের চোখে মুখে আত্মতৃপ্তি দেখে জানতে পারলাম তারা এর আগেই মনমতো শট্ পেয়ে গেছে। আমরাও সকলে প্রার্থনা করতে থাকলাম। পনেরো-ষোলটা বোটে প্রায় আশি-পঁচাশি জোড়া চোখ তখন সামনের খাঁড়ির দিকে নিবদ্ধ । ক্যামেরাগুলো সব তাক করা রয়েছে। চারদিকে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। চাপা একটা উত্তেজনা অনুভব করছি। এমনসময় একটা পাখি উড়ে যেতেই আমাদের সচেতন করে দিল সুবলদা । হেতালের পাতাগুলো নড়ে উঠলো। বাদাবনের রানির (ছোট মা) দেখা পেলাম। চারদিকে তখন শুধুই সাটারের আওয়াজ। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন রানি। একবারমাত্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের দিকে তাকালেন, এরপর লাফ দিয়ে খাঁড়ি পেরিয়ে অদৃশ্য হলেন। সকলের হইহই আর আনন্দটা সেই মুহূর্তে দেখার মতো। লেন্সবন্দি করতে পেরে কেউ কেউ আবেগের বশে চিৎকার করে ফেললো। প্রত্যেকের চোখে মুখেই এক পরিতৃপ্ততা। ঠিক যেন যুদ্ধ জয় করেছি আমরা। সত্যিই সে এক অন্য মুহূর্ত যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আমাদের কুক বাবুসোনাদা অসাধারন সব মাছের পদ রান্না করে সকলকে খাওয়াচ্ছিল। কিন্তু আমরা তখন সেসব ভুলে বাদাবনের রানিকে লেন্সবন্দি করতে কতোটা সফল হয়েছি তা দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমন প্রাপ্তির পর খাওয়াটা সেসময় সকলের কাছেই প্রায় একপ্রকার নগণ্য হয়ে গেছিল। আসলে সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়াটা সত্যিই চরম ভাগ্যের ব্যাপার। অনেকেই বহুবার গিয়েও বড়ে মিঞার দর্শন পায় না। আর এত বড় এই নরম পায়ের প্রাণীটিকে উদরপূর্তি হেতু ম্যানগ্রোভের কাঁটাভরা নরম কাদায় চলাফেরা করতে , ঘন ঘন খাল-নদী সাঁতার কেটে পেরোতে হয় – যা কিনা পৃথিবীর অন্যান্য বনের বাঘের তুলনায় অনেক বেশী কষ্টসাধ্য। বড় শিকারের অভাবে এখানকার বাঘের মেন্যুতে বাঁদর, ভোঁদড়, বিড়াল ,মাছ এমনকি কাঁকড়াও থাকে – যা অনেকটা তাদের স্ন্যাক্সের কাজ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, বাঘ তার নিজের গন্ধ ঢাকতে হাওয়ার বিপরীত দিক থেকে শিকার করে থাকে। সাধারণত সে তার পরিচিত পরিবেশেই থাকতে ভালবাসে এবং নিজের এলাকায় অন্য বাঘের উপস্থিতি সহ্য করে না। বনে কাঠ, মধু ,চিংড়ি কিংবা কাঁকড়া সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মানুষজন প্রবেশ করলে ধূর্ত বাঘের নজরে তারা সহজেই চলে আসে। অন্যান্য জায়গার বাঘের চেয়ে এখানকার বাঘেরা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বসে মানুষের ব্যবহার-আচরণ দেখার সুযোগ পায়। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাসে অবশ্য বাঘ ও বনচারীর মধ্যে একটা সতর্ক সহাবস্থান সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যা তাদের মনস্তত্বে বিভ্রান্তি ঘটায় না।
জঙ্গলে এরপর বাকি দুদিন আমরা দেউলভাড়ানি, নবাঁকি, খলসীভারনী, বনবিবিভারনীর দিকে ঘোরাঘুরি করলেও পিরখালির যেখানে ছোট মা কে দেখেছিলাম সেখানেই আবার হাজির হয়েছিলাম। কয়েকদিন আগেই সেখানে বাচ্চা সহ মা বাঘকে নদীর চরে খেলা করতে দেখা গেছিল। আশায় আশায় বুক বেঁধে রইলাম, যদি আমরাও এমন দৃশ্যবন্দি করতে পারি। না তেমন কোন করিশ্মা আর ঘটে নি।
এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রাণীদের নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে কত গবেষনা, গভীর অনুসন্ধান চলছে। অথচ শেষ বিন্দুতে অবস্থিত এই সুপ্রাচীন ভূখণ্ডের সামগ্রিক ঐশ্বর্য কি অসীম অবহেলায় আজও অক্ষয় এবং চিরভাস্বর হয়ে আছে।
ঘন অরণ্য আর সবুজাভ নীল জলে কয়েকদিন ধরে কাটানোর পর এখানকার প্রকৃতির প্রেমে পরে গেলাম। ফিরতে মন চাইছিল না। অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছিলাম। সুন্দরবন ভ্রমণ প্রসঙ্গে ভিন্ন জনের ভিন্ন মতামত থাকবেই এ কথা সত্য। তবে চোখের আলোয় বাইরের জগতই শুধু দেখা যায় কিন্তু অনুভুতির আলোয় দেখা যায় অন্তরের জগত। সুন্দরবনের এই দৃশ্যমান জগতকে অনুভূতির আলোয় দেখার পদ্ধতিটাও তাই অবশ্যয় ভিন্ন ভিন্ন হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার কাছে সুন্দরবন প্রকৃতির এক অপরূপ, অনন্য সৃষ্টি। যার আছে অপার সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধতায় ভরায় এক নির্লিপ্ত বনানী।
কুহেলী বন্দ্যোপাধ্যায়
তথ্য —
সুন্দরবনের সমাজ ও সংস্কৃতি – ডঃ মনীন্দ্রনাথ জানা
পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি – বিনয় ঘোষ
সুন্দরবন সমগ্র – শিবশঙ্কর মিত্র
সুন্দরবনের বাঘ – খসরু চৌধুরী
4 responses to “ভ্রমন // প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য ও বিস্ময়ে মোড়া সুন্দরবন”
অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ বিবরণ।ওই চার দিনের কাটানো সময় আবার মনের মণিকোঠায় ভিড় করে এলো।
অনেক ধন্যবাদ দিদি। তুমি ঠিকই বলেছো। তবে তোমার সাহায্য ছাড়া এমন সুন্দর অভিজ্ঞতা হতো না।
Thanks!
Most welcome.