মিশন বাদশা


     কুহেলী ব্যানার্জী

মোগাম্বো খুশ হুয়া ( পর্ব – ২ )

 

 ওমা !  সে কিরে?  বলিস কি? বিড়ালকে তো ‘বাঘের মাসি’ বলে ব’লেই জানতাম।  কিন্তু তাই বলে সরাসরি বাঘ!  মানে বাঘের আওয়াজ? এও আবার হয় নাকি?   তুই কি শুনতে কি শুনেছিস দেখ গিয়ে।  কারবালার বিশিষ্ট নেড়ি আলুকাবলি অন্য এক নেড়ি কুকুর মশাকে বলল।  নেড়িটার আলুকাবলি নাম  দিয়েছে ওই পাড়ার দুই ছাগল। রাম্বা-সাম্বা। আসলে আলু-ঝিঙে-পটল এসব তো তাদের খাবার। কিন্তু হয়েছে কি নেড়িটা প্রতিদিন মোড়ের মাথায় বসা ফুচকার স্টলে গিয়ে  আলুকাবলি খেতো । দোকানের মালিকটাও ছিল বেশ দানী স্বভাবের। সেই নাকি ওর অমন নাম দিয়েছে। ওদিকে মশার দশাটা হল পুরো হাড়গিলে বেরোনো জরাজীর্ণ রুগ্ন প্রকৃতির।  দেখলে তেমন ভক্তি শ্রদ্ধা তো জন্মায়ই না বরং কেমন যেন একটা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ গোছের অবস্থা হয়।  সেই কারনে ওকে নিয়ে কারো বিশেষ মাথাব্যথাও নেই। তাই ওর নামটা যে ঠিক কার দেওয়া  তা এখনো পর্যন্ত অজানাই থেকে গেছে।      

            

 আসলে মোগাম্বোর মার্জারস্বরের বদলটা হঠাৎ করে সকলকে বড্ড চমকে দিয়েছে। সকলেই কেমন যেন একটা রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছে। ব্যাপারটা পুরো এলাকায় জানাজানি হতেই পশু মহলে বিরাট একটা  হইচই পড়ে গিয়েছে।  আর হবে নাই বা কেন এমন কখনো কেউ বাপের জন্মে ঘটতে দেখেছে নাকি? না শুনেছে?  পাড়ার তাগড়ায় কুকুর বুলেট থেকে শুরু করে নেড়ি মশা, আলুকাবলিরা পর্যন্ত ওই বাদশাকে বড্ড ভয় পেত।  আসলে হুলোটার অত্যাচার উত্তরোত্তর  বেড়ে চলাতে এলাকা জুড়ে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সিতারাদের খাবার লোপাটের সাথেসাথে প্রায়দিন বাদশা ওর বেশ কটা সঙ্গীসাথী নিয়ে ওদেরও খাবারে ভাগ বসাতো। বেচারাদের ভালো করে পেট পর্যন্ত ভরতো না। একরকম উপোষ করে কাটাতে হত। পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতিতে ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে পড়ছিল।

********************************************************************************

            

ঘন্টিলাল, সিতারা, বিজলী, বগা, চমচম সকলে মুগাম্বোর সাথে ছাতিম গাছটার নিচে বসে আছে। আকাশে তখন শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ । ঝড়ো হাওয়া বইছে। গাছের পাতাদের ঝরঝর-সরসর আওয়াজে কারো কথা ভালো মতো শোনা যাচ্ছে না। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বকেরা কালো মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। বিকেলের আলোটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।  এইমাত্র ওরা সবাই বাদশার এলাকা থেকে ফিরল। বেশ ঝোঁপঝাড় রয়েছে ওদিকটায়। ফণীমনসার কাঁটায় সকলেরই শরীরে অল্পবিস্তর ক্ষত হয়েছে। তবে ‘মিশন বাদশা’য় ওরা টোটালি সাকসেস।  সকলের চোখে-মুখে  উত্তেজনার রেশটা তখনো কাটেনি।  মারামারিটা যে বেশ ভাল রকমেরই  হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছিল। আসলে বাদশার ক্ষমতার সাথে আজকাল ঠিকমতো কেউ পেরে উঠছিল না। কিন্তু আজ সেই অঘটনটা শেষপর্যন্ত ঘটলো। যখন বাদশার সামনে মোগাম্বো  লোম ফুলিয়ে, ল্যাজ উঁচিয়ে একটা গর্জন দিলো তখন তার তো সে একেবারে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা ! মোগাম্বোর হালুম গর্জনে সে  একেবারে পড়ি কি মড়ি করে ছুটে পালিয়েছে । দিকবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে বাদশার ছুট লাগানোর মুহূর্তটা ছিল সত্যিই দেখবার মত । সিতারারা তো ওকে দেখে হেসেই  খুন।  যাইহোক, ওদের  বহুদিন ধরে চলা সমস্যাটা আজ  মিটতেই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে সকলে। ‘মিশন’ শেষে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে একটু সেলিব্রেট করবে ভেবেছিল। তবে ওয়েদারটা আজ ঠিক জুতসই লাগছে না। মনে হচ্ছে বরুণদেব ওদেরকে বিটট্রে করবে।

           

কিন্তু মোগাম্বোকে আজ আর কেউ ছাড়বার পাত্র নয়। ব্যাঘ্র সম্বন্ধীয় যাবতীয় রহস্যের উদ্ঘাটন করে তবেই সকলে ছাড়বে। শেষপর্যন্ত সবার বড্ড জোড়াজুড়িতে ব্যাপারটা মোগাম্বোকে  খোলসা করতেই হলো। সানুর কাছে শোনা ওর ছোটবেলার গল্পটা মোগাম্বো বলতে থাকলে বাকি সকলে এক  মনে সে কথা শুনতে থাকলো ।  চোখে তখন ওদের অপার বিস্ময় !

               

 সানুরা সেবার পুজোর ছুটিতে সুন্দরবনে গেছিল। সেটাকে একটা ফ্যামিলিট্যুরই বলা যেতে পারে । সকলে অসম্ভব রকমের মজা আর আনন্দে কাটিয়েছিল। বোটের মধ্যেই সারাদিন খাওয়া-দাওয়া। আর তার মাঝে বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারদের দেখাটা ছিল ওদের কাছে এক্কেবারে আলাদা রকমের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।  ওর কাকু, পিসি-পিসাই  মিঠি, ডিম্পি, রিভু সকলে মিলে খুব হইহই করে করেছিল। তবে জঙ্গল তো, বেশি চেঁচামেচি করা যাবে না।  প্রকৃতির মাঝে থাকার আনন্দটা ওদের সকলকে যেন একবুক অক্সিজেন জুগিয়েছিল।  

             

একদিন বিকেল নাগাদ সানুরা ঘুরতে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মুগাম্বোকে আবিষ্কার করে। হ্যাঁ, আবিষ্কারই বলা চলে ওকে। নইলে অমন ধ্যারধ্যারা গোবিন্দপুরে, যেখানে জনমানুষ্যি পর্যন্ত নেই সেখানে ওকে কেমন করে পাবে।  ছোট্ট নরম তুলতুলে মোগাম্বোর চোখটা ছিল ভারি মায়ামাখা। গলায় একটা ছোট্ট বেল্টের মতো কিছু একটা বাধা ছিল।  জঙ্গলের মধ্যে ওকে কেউ ফেলে রেখে আস্তে পারেনি। কেমন যেন একটা মায়া হচ্ছিল। মুগাম্বোকে বাড়ি নিয়ে এসে সানুদের অবশ্য বেশ খানিকটা ডাক্তার-বদ্যির হাঙ্গামা পোয়াতে হয়। 

           

কিন্তু এর সাথে গলার আওয়াজ পরিবর্তনের ব্যাপারটা কেউ বুঝে উঠতে না পেরে সকলে হাঁইহাঁই করে চেঁচিয়ে উঠলো।  মোগাম্বো সকলকে শান্ত করার পর তার গলায় থাকা বেল্টটা দেখালো। যেটা ছোটবেলায় তার গলায় ছিল। তারপর বহুদিন সেটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ সেদিন সানু তার পুরনো খেলার বাক্সে খুঁজে পায়। আর সেই থেকে ওর গলার এমন পরিবর্তন আসে। 

          

মোগাম্বো সানুর কাছে জানতে পারে প্রফেসর শঙ্কুর বটিকা ইন্ডিকা, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, মাইক্রোসনোগ্রাফের মতোই বেল্টটাও কোন অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার হবে।  কি জানি কে করেছে ? নিশ্চয় কোন বিজ্ঞানীই হবেন। একটা সাধারণমানের দেখতে বেল্টের জন্য এতো কাণ্ড জেনে  সিতারাদের চোখ তো কপালে ওঠার জোগাড়। এমন অদ্ভুত কথা তারা কখনো শোনেনি। প্রফেসর শঙ্কুটাই বা কে ? সকলে জানতে চাইলে মোগাম্বো একটু রাশভারী গলায় তাঁর বিষয়ে  পুরো ডিটেইলসে বললো। তাতে যে সকলের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকল তা কিন্তু নয়। আর মোগাম্বো এইসব জ্ঞানবাক্যগুলো সানুর কাছ থেকেই ঝাড়ি মেরেছে। নইলে ওর মুখে এমন জ্ঞানগর্ভমার্কা কথা চট করে শোনা যায় না। ওর মতে  লাইফ একটাই , খাও-দাও   আর আয়েশ করে ল্যাদ মেরে পড়ে থাকো। … এহি হ্যায় জিন্দেগি ভাইয়া ……।

          

   তবে ওর জন্মের সময়কার এসব অজানা কথা ওকেও বড্ড আশ্চর্য করেছিল।  মোগাম্বো তো জানতোই না সুন্দরবন বলেও একটা দেশ আছে।  সে দেশে নাকি বড় বড় রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে।  সেখানে নাকি কত রকমের  জন্তু-জানোয়ার আছে। সে ভারি আশ্চর্যের দেশ।  জলে- জঙ্গলে ভরা। সকলে বলে সেখানে নাকি জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘ।  মোগাম্বোর ভারী  ইচ্ছে হয় সেই জায়গা দেখার।

       

  গল্প করতে করতে কখন  যে সন্ধ্যে হয়ে গেছে ওরা কেউ খেয়াল করেনি।  মেঘ কেটে গিয়ে একাদশীর চাঁদ দেখা দিয়েছে।  মোগাম্বো হাই তুলে, ছোট্ট একটা আড়ি মুড়ি ছেড়ে  উঠে বসে।  

 

বাই বন্ধুরা, আজ আসি।

     

এই বলে  গুট গুট করে এগিয়ে যায়। সেদিনকার মত ওদের আড্ডাটা ওখানেই শেষ হয়।                                   

                                                          (ক্রমশ)