বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন চিনের এক জনৈকা রানি। গরম চায়ের পেয়ালায় টুপ করে এসে পড়ল ছোট্ট একটি গুটি। চায়ের ওমে সেই গুটি থেকে বেরিয়ে এলো এক সূক্ষ্ম সোনালি রঙা সুতো। জনশ্রুতি আছে, এভাবেই চিনদেশে আত্মপ্রকাশ ঘটে রেশমের। ঠিক যেন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের, গাছ থেকে আপেল পড়ার মতো। চায়ের কাপ থেকে রেশমের বিস্তৃতি ঘটে সমগ্র বিশ্বে।
রেশমের সাথে মানব সভ্যতার যে টানাপোড়েনের ইতিহা্স, এর যোগাযোগ সুদুর অতীতের রেশম পথ ধরে। আঁকাবাঁকা,দুর্গম রেশম পথের মতোই রেশমের বিবর্তনের ধারাও অমসৃণ। জিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্বে আবিষ্কৃত এই রেশম এ্কসময় চিন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর রপ্তানি হওয়ায় সেই পথের নাম হয় রেশম পথ বা সিল্করুট। চিন থেকে ভুমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই পথের দৈর্ঘ্য ছিল ৪০০০ মাইল। বানিজ্য ছাড়াও, সেকালে এই পথেই দেশবিদেশের মধ্যে বিনিময় হতো জ্ঞানবিজ্ঞান, সংস্কৃতির এবং ভাবনাচিন্তার। সুদুর প্রাচীনকালে বৌদ্ধধর্ম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এই পথ ধরেই। এরপর সিল্কের বিস্তৃতি ঘটে ধীরে ধীরে ভারত, জাপান এবং পারস্য (বর্তমান ইরান) পর্যন্ত। তুঁত রেশম তিব্বত হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে বলে জানা যায়।
রেশমের ইতিহাস হাতড়ে দেখা যায়, বাংলার যে এই শিল্প তা নেহাত আজকের নয়। স্কুল পাঠ্যে বইয়ের পাতায় পড়া ইংরেজ শাসনকালে ভারত তথা বাংলার বস্ত্রশিল্পের যে নিদারুন অবক্ষয় হয়েছিল …. এ তার চেয়েও প্রাচীন। ঋকবেদ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে রচিত উপনিষদে গাঙ্গেয় সমভুমিতে পোশাক ব্যবহা্রের প্রমান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকরা ভারতীয় গাঙ্গেয় সভ্যতাগুলিতে খননকার্য চালিয়ে সুতো কাটার বস্ত্রবয়নের ছোট ছোট কল এবং কাপড় রঙ করার চৌবাচ্চার সন্ধান পেয়েছেন। মহাকবি কালিদাসের রচনাতেও একপ্রকার সূক্ষ্ম কাপড়ের বিশেষ বর্ণনা রয়েছে যাতে জানা যায় সে সময় গাঙ্গেয় উপত্যকায় উৎপন্ন মসলিন ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যেত।
মানবসভ্যতার প্রারম্ভে আমরা দেখি, আদিম মানুষ প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে বাঁচতে গাছের বাকল, পশুর চামড়া ব্যবহার করত। তারা মাকড়সার জাল বোনা, পাখির বাসা বোনা দেখে কাপড় তৈরির ধারনা পায় বলে মনে করা হয়। নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন নব্যপ্রস্তরযুগে প্রথম ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ চামড়া সেলাই করা শেখে। বিভিন্ন ধরনের হাড় ও হাতির দাঁতকে সুঁচ হিসাবে আর পশুর নাড়িভুঁড়ি-ধমনিকে সুতো হিসাবে তারা ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে তারা শন, কলা জাতীয় গাছের তন্তুকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে কাপড় জাতীয় বস্ত্র তৈরি করতে শেখে। আদিম মানুষের হাতেই সেই প্রথম তাঁত উদ্ভব। তবে কিছুদিন পূর্বে ফ্রান্সের এক গুহা থেকে বিজ্ঞানীরা আধুনিক মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ব্যবহৃত পঞ্চাশ হাজার বছরের পুরনো সুতো আবিস্কার করেছেন। যা দেবদারু গাছের বাকল থেকে তৈরি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীতে পালি সাহিত্যে কাপড়ের পোশাকের কথা আছে। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা এক ধরনের তাঁত ব্যবহার করত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ অব্দে গ্রীসে মাটির পাত্রে প্রাচীন তাঁতের ছবি আছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর সভ্যতাগুলিতেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়। সাঁচির বৌদ্ধস্তুপে গাছের বাকলের তৈরি কাপড় দেখা যায়। আর্য-অনার্যরাও এইরকম কাপড় ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে পালযুগের ভাস্কর্যে শাড়ির ব্যবহার দেখা যায়। প্রাচীন বাংলায় উচ্চবৃত্ত সম্প্রদায়ে মসলিন, রেশমকাপড়ের ব্যবহার থাকলেও সাধারন জনগন মোটা সুতোর কাপড়ই ব্যবহার করতো। সেকালের সম্ভ্রান্ত মহিলারা অবশ্য রেশম ছাড়াও সুতি, চান্দেরি, বেনারসি, জামদানী , পচনপল্লি, বালুচরি পড়তেন।
তবে চিনকে রেশমের আঁতুড়ঘর বলে মনে করা হলেও খ্রিষ্টের জন্মের বহু আগে থেকেই বাংলাতেও একপ্রকার রেশমের চাষ হতো। যা অতুঁত রেশম নামে পরিচিত। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে মোঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায়(অবিভক্ত) তথা মুর্শিদাবাদে রেশমশিল্পের প্রসার ঘটেছিল। সে সময় বিভিন্ন দেশে বাংলার মসলিনের চাহিদা ছিলো আকাশ ছোঁয়া। এমনকি এই সিল্কের টানেই দেশের বিভিন্ন প্রদেশের রাজারা তাঁদের তাঁতিদের পাঠাতেন রেশম চাষের পদ্ধতি শেখার জন্য। ততদিনে অবশ্য নিজস্ব রেশম ও চিন থেকে আসা তুঁত বা মালবেরি রেশম দুটিতেই বাংলা খ্যাতি অর্জন করেছে । বাংলা থেকেই পরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে রেশম চাষ বিস্তার লাভ করে। এই শিল্পের টানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল শাসনকালে বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। যার ফল স্বরূপ বাংলার শিল্পের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়।
সেকালে বাংলায় যে অতুঁত রেশমের চাষ হতো তা তিন প্রকারের- তসর, মুগা এবং এরি। তবে এই মালবেরি তুঁতের চাষ ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার সঠিক তথ্য অজানা। বাংলায় রেশম উৎপাদনের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে দেখা যায়, গ্রামের গৃহস্থেরা তিনটি পর্যায়ে রেশম উৎপাদন করতো ১. মালবেরি বা তুঁত চাষ ২.রেশমগুটি লালনপালন এবং ৩. কাপড় তৈরির জন্য রেশমগুটির সুতো পৃথক করা। এটি কৃষিভিত্তিক শিল্প হলেও এর উৎপাদন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। সেরিসিন নামক এক প্রকার প্রোটিন হল এর গাঠনিক পদার্থ। বোমবিকস মোরি বর্গভুক্ত রেশম পোকার গুটি থেকে তৈ্রি সুতো দিয়ে বোনা একপ্রকার সূক্ষ্ম ও কোমল তন্তু হল রেশম। মালবেরি তুঁতের মথ বা পলু পোকা কে সহজেই ঘরে পালন করা যায়। কিন্তু তসর, মুগা রেশমের পলু বন্য। এরা অর্জুন, আসান,শাল,সেগুন ইত্যাদি গাছের পাতা খেয়ে থাকে। পাতার রঙ অনুযায়ী তাই রেশমের রঙও হয় ভিন্ন। রেশমগুটি আসলে রেশমমথের শুঁয়োপোকা। রেশমমথ > ডিম > শূককীট > মুককীট >পূর্ণাঙ্গ পোকা এই পর্যায়ক্রমে এর জন্মচক্র চলে। মুককীট মুখ থেকে একপ্রকার লালা বের করে নিজেকে আবৃত করে। আবরণ সহ মু্ককীটকে কোকুন বলে। পরিপূর্ণ কোকুনকে কয়েক মিনিট সেদ্ধ করার পর ডিসেকটিং নিডল দিয়ে সুতো বের করা হয়। আবহাওয়া অনুযায়ী রেশম অথবা তসর উভয় প্রকার গুটি থেকে নির্দিষ্ট সময় পর মথ বের হয়। তবে মথ বেরিয়ে গেলে গুটির গুণ কমে যায়। তা থেকে উৎকৃষ্ট মানের কাপড় তৈরি হয় না।
সিল্কের উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে এর চাষ হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গেও রেশম চাষ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। রাজ্যে রেশম তাঁত শিল্পটি মুলত মালদা,মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে হয়ে থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য রেশম চাষের অবদান অনস্বীকার্য। বীরভূম জেলায় নলহাটি, মুরারই, মল্লারপুর, ভদ্রপুর, দুবরাজপুর, বোলপুর ইত্যাদি এলাকাগুলিতে পলুপোকার চাষ হয়ে থাকে। কোটাসুর (সাঁইথিয়া-বহরমপুর রোড) এর কাছে নারানঘাটি ও প্যাটেলনগর রেশমকেন্দ্রে রাজ্য ও কেন্দ্রসরকারের অধীনে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগমুক্ত ডিম প্রতিপালিত হয়। নারানঘাটিতে মুলত রেশমগুটির ডিম প্রতিপালন হলেও জেলায় রেশম শাড়ি তৈরি হয় না। প্যাটেলনগর কেন্দ্রে তসরগুটি সংরক্ষণ থেকে ডিম প্রতিপালনের এক সুদীর্ঘ পর্যায় অবলম্বন করা হয়। এলাকাগুলিতে পোকা পালনের উদ্দেশ্যে অর্জুন ও তুঁত গাছের চাষ করা হয়। এই কেন্দ্রগুলি থেকে বিভিন্ন জেলার এবং অন্য রাজ্যের চাষিরাও ডিম সংগ্রহ করেন। চাষিরা পলু চাষ করেন অতি যত্নের সাথে। অনেকটা কেয়ারি বেবির মতো। পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়া গুটিকে চাষি বিক্রি করে দেন তাঁতিকে।
তবে জেলায় তসরশিল্পের কাজ হয় সিউরির কাছে তাঁতিপাড়ায় । এখানে গুটি থেকে সুতো তৈরির কাজ সাধারনত মেয়েরাই করে থাকেন। চরকার সাহায্যে তসরগুটি থেকে তন্ত বের করা হয়। এরপর চাকা লাগানো যন্ত্র দিয়ে সুতোকে সমান করা হয়। বিশেষ থাই পদ্ধতিতে মহিলারা সুতোকে মসৃণ করেন। শাড়ির গুনাগুণ এর ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। তসর কাপড়গুলিকে তরল রাসায়নিক পদার্থের দ্বারা পালিশ করা হয়। সাধারনত ১মণ রেশম সুতো থেকে ৪কেজি মতো সুতো তৈ্রি হয়। আর তসরগুটির ক্ষেএে ১কাহন এ ১২৮০টি গুটি থেকে ৯০০-১২০০ গ্রাম সুতো তৈ্রি হয়। ১কেজি সুতোর বাজার মুল্য ৪০০০ টাকা। গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত। বর্তমানে এখানে সুতো থেকে শাড়ি তৈরির সম্পূর্ণ প্র্রক্রিয়াটিই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তর্গত কে.ভি.আই.সি দ্বারা পরিচালিত। সংস্থার সাথে যুক্ত গ্রামের শিল্পীদের প্রাপ্য মজুরিও এই কমিশনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।গ্রামে বেশ কিছু পরিবার শাড়ি রঙের কাজে যুক্ত। তাঁরা গ্রামেরই তাঁতিদের বোনা থান থেকে শাড়ি, পাঞ্জাবীর কাপড়, স্টোল তৈরি করেন। তবে শাড়িই বেশি করেন তাঁরা। বাজারে এগুলির চাহিদা আছে। কিন্তু আগের তুলনায় কম। শিল্পীদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই শিল্প কিছুটা হলে উপেক্ষিত। দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প যেন হারিয়ে না যায় পরবর্তী প্রজন্ম যাতে গৌরবের সাথে সেই ধারাকে বহন করে তা একান্তই কাম্য।
আমরা যারা সিল্কের অনুরাগী তাদের সংগ্রহে সিল্ক এখনো প্রথম সারিতে । রেশম শাড়ির চাহিদা আজও অক্ষুণ্ণ। সিল্কের ঔজ্জ্বল্য, কোমল স্পর্শ, হাল্কা এবং টেকসই হওয়ার জন্য সকলের কাছেই তা আদরণীয়। রেশমকে সেই কারনেই বলা হয় বয়ন শিল্পের রানি। আর তাই তো অষ্টমীর অঞ্জলী থেকে যে কোন উৎসব – অনুষ্ঠানে …. সর্বত্রই সে স্বতন্ত্র ভাবে আপন গুণ ও মহিমার দ্বারা আজও বিরাজমান।