আমাদের বাঙালীদের কাছে পুজো –পার্বণের একটা আলাদাই মাহাত্ম্য আছে। যার মধ্যে কিনা আচার-আচরণ, বিধিনিষেধের থেকেও যেন দেবতাকে (পরমাত্মা) আপন করে নেওয়াটাই বেশি। অনেকটা নিজের আত্মীয় তুল্য মনে করা। পরমাত্মীয়কে নিকটাত্মীয় করে তোলার সুদীর্ঘ সেই পথটা আমাদের অজান্তেই কবে যেন তৈরি হয়ে যায়। মা কে যেমন তার সন্তান লালন-পালন করা শেখাতে হয় না। জন্মগতভাবেই সে এই কাজে পারদর্শী হয়। এও যেন অনেকটা তেমনই।
আর তাই মা দুর্গা, শিব, লক্ষ্মী-নারায়ন থেকে সরস্বতী সকলেই যেন আমাদের বড় আপনজন। তাঁদের পুজোকে কেন্দ্র করে আমরা মেতে উঠি। পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গ্রাম-শহরের সমস্ত বিদ্যা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এক উন্মাদনা অনুভব করা যায়। আর আমাদের মতো বড়দের কাছে সরস্বতী পুজো মানে তো শৈশবটাকে যেন আরও একবার পাতা উল্টিয়ে দেখার দিন। কত হাসি, মজা যে এই দিনটাকে ঘিরে জড়িয়ে থাকে – তা বলার নয়। এ বছর পরপর বোর্ডের পরীক্ষাগুলো থাকায় সেই উন্মাদনায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। এখনও পুজোর দিনগুলো কাছে আসতে না আসতেই রাস্তার এখানে ওখানে কচিকাচাদের চাঁদার আব্দার দেখি।
কিন্তু যে আরাধ্যা বাগদেবীকে ঘিরে এতো উন্মাদনা বছরের পর বছর চলে আসছে কি তার ইতিহাস? আর তাকে নিয়ে কিই বা উপাখ্যান জড়িয়ে আছে তা জানার আগ্রহ ছোট-বড় সকলের থাকাটাই স্বাভাবিক। সেটাই এখন জানার চেষ্টা করবো।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বৈদিক যুগে যে কয়েকজন দেবদেবী পূজিতা হতেন তার মধ্যে সরস্বতী ছিলেন অন্যতমা। ঋকবেদ থেকে দু প্রকার সরস্বতীর ধারণা স্পষ্ট হয় ; এক ত্রিলোকব্যাপিনী সুর্যাগ্নির দ্যুতি আর এক সরস্বতী নদী। তিনি জ্যোতিরূপে ও নদী রূপে পূজিতা হয়েছেন। কৃষ্ণযর্জুরবেদে, ভাগবতে ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সরস্বতী যে সুর্যাগ্নির জ্যোতি তা বলা হয়েছে। আবার ভৃগুউপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে – অপ্ সু জ্যোতিঃ প্রতিষ্ঠিতম্ । জ্যোতিবষাপঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ। স্বামী নির্মলানন্দ ‘সরস্বতী’ শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সরস’ শব্দের প্রকৃত অর্থ জ্যোতিঃ, অস্ত্যর্থে বতু এবং স্ত্রীলিঙ্গে ঈপ প্রত্যয় করে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী শব্দটি। আলোকময়ী বলেই তিনি সর্ব শুক্লা। তাই সরস্বতীর সাধনা জ্যোতিরই সাধনা।
বলা হয় বেদ আর সরস্বতী অভিন্ন। তিনি বেদ-বেদাঙ্গ-বিদ্যার প্রসুতি। ঋকবেদে সরস্বতীর সাথে বিদ্যাধিষ্ঠাতৃত্বের কোন সম্পর্ক না থাকলেও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগরূপা। পরবর্তিতে বৈদিক সরস্বতী অভিন্ন হয়ে ওঠেন পৌরাণিক বাগদেবী বরদা বাগেশ্বরীর সঙ্গে। কালক্রমে সরস্বতী হয়ে ওঠেন ভাষার দেবী। এই কারনে বলা হয় – ‘বাক হি সরস্বতী‘। ত্রিলোক জুড়ে জ্ঞানময়ী রূপে তিনি সর্বত্রব্যাপিনী। এই বিশ্বভুবন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শুক্লজ্যোতিতে। তিনি জ্যোতির্ময়ী, তিনি তিমির বিনাশী । দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক। তাই তিনি শ্বেতবর্ণা , শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা। বীণা ও পুস্তকধারিণী । প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় সভ্যতায় তিনি সংস্কৃতির, বিদ্যাবুদ্ধি , সৃজনীপ্রতিভা , চারুকলা , বিজ্ঞানের দেবী রূপে পূজিতা হতে থাকেন।
বৃহস্পতি জ্ঞানের দেবতা, তিনি যেমন বাক্পতি তেমন ইন্দ্রও বাক্পতি। কোথাও তিনি বৃহস্পতি-পত্নি জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী স্বরূপা। কোন পুরাণে তিনি ব্রহ্মার পত্নী আবার কোথাও বিষ্ণুর পত্নি। ভাগবত পুরানে বলা হয়েছে তিনি ব্রহ্মার কন্যা ; ব্রহ্মার মুখ থেকে নির্গত হয়েছিলেন। তিনি আবার শিব-দুর্গার কন্যাও। অবশ্য কোন কোন পুরাণে তাঁকে শিব-শক্তিরূপে ও দেখা যায়। যাইহোক না কেন মূলত সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার সূর্যাগ্নিরূপী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। আর তাঁদেরই শক্তিরূপ জ্যোতিস্বরূপা জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। বৈদিক যুগে সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে সামমন্ত্র গাওয়া হত । প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে হবিঃপ্রদানের সময় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হওয়ায় তিনি হলেন বিদ্যারূপা বা বাগরূপা – জ্ঞানের উদ্দীপনকারিণী।
‘তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ ।
কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিসন্না সিতাব্জে ।।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ ।
সকলবিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগদেবতা নঃ ।।‘
দেবী সারদার বহুল প্রচলিত ধ্যানমন্ত্রে যে রূপ বর্ণীত হয়েছে তার অর্থ এই দাঁড়ায় – যাঁর ললাটে বিরাজিত তরুণ শশিকলা, যিনি শুভ্রবর্ণা, কুচভারাবনতা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, যাঁর এক হাতে উদ্যত লেখনী অপর হাতে পুস্তক শোভা পায়, সেই বাগ্দেবতা সকল বিভব সিদ্ধির নিমিত্ত আমাদের রক্ষা করুন।
ঋকবেদে সুপ্রসিদ্ধ নদী স্তুতিতে যে সব নদীর কথা আছে তার মধ্যে সরস্বতী অন্যতম। আচার্য যাস্ক তাঁর ’নিরুক্ত’তে বেদের দেবতা তত্ত্বের আলোচনায় বলেছেন সরস্বতী শব্দের অর্থ ‘যাতে জল আছে’। সৃ ধাতু নিষ্পন্ন সর শব্দের অর্থ জল; জল আছে যাতে তাই সরস্বতী। এই নদীর তীরে প্রসিদ্ধ রাজারা এবং পঞ্চজাতি বাস করত। সরস্বতী তাঁদের সমৃদ্ধি প্রদান করেছিলেন। একসময় বৈদিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠা নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র। নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছিল তপোবন। ঋষিরা সেখানে বেদ পাঠ করতেন। সূচনা ও সমাপ্তিতে করতেন সরস্বতী নদীর বন্দনা। রচনা করতেন বৈদিক সূক্ত। তাই তিনি জ্ঞানের দেবী। কালক্রমে নদী হয়ে গেলেন বিদ্যার দেবী। অবশ্য এই দেবায়নের অন্যতম কারন হল ধীরে ধীরে নদীটির অবলুপ্তি। খ্রিঃ পুর্ব তৃতীয়-চতুর্থ সহস্রাব্দে উত্তর পশ্চিমে ভারতে প্রবাহিত ছিল এই নদী। হিমালয়ের সিমুর পর্বত ছিল এই নদীর উৎসস্থল। । মহাভারত রচিত হওয়ার আগেই নাকি এই নদী বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে লুপ্ত হয়ে গেলেও এই নদী ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আজও জড়িত। লোকবিশ্বাসে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে এর যুক্তবেণী রচনা করা হয়েছে এলাহাবাদের প্রয়াগে।
এই নদী ছিল বৈদিক যুগের মানুষের অন্ন ও সম্পদের উৎস। নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে উর্বর পলিতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হওয়ায় আর্যদের জীবিকা ও সম্পদের অন্যতম উৎস ছিল সরস্বতী নদী। তাই তিনি অন্নময়ী – অন্নদাত্রী রূপেও স্তুতা হয়েছেন। বৈদিক যুগে তিনি ছিলেন ধনেরও দেবতা। সে যুগে ভালো ফসল লাভের আশায় মেয়েরা ‘সারস্বতব্রত’ পালন করতেন ।
যাইহোক নদী সরস্বতী যে কেবলমাত্র বৈদিক যুগেই প্রসিদ্ধ ছিলেন তা নয়। মহাভারত,পুরাণে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগদেবী রূপে প্রসিদ্ধা। পরবর্তী কালে বৈদিক সরস্বতীর অন্যান্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী রূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
বৈদিক যুগে দেবদেবীর মূলত কোন মূর্তি বা অবয়ব ছিল না। ঋষিগণ মন্ত্রের মাধ্যমেই অবয়ব রচনা করে দেবার্চনা করতেন। তাঁরা প্রকৃতিতে ঈশ্বরত্ব আরোপ করে দেবার্চনা করতেন। খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ দেবীর মুর্তিরূপ কল্পিত হয়েছে। বায়ু পুরাণে দেবী চতুর্ভূজা হংসারূঢা আর অগ্নিপুরাণে অষ্টভুজা। তবে বিভিন্ন পুরাণে দেবীর ভিন্ন ভিন্ন রূপের বর্ণণা থাকলেও আধুনিককালে তিনি দ্বিভুজা এবং বীণাহস্তা। আচার্য যোগেশচন্দ্রর মতে দ্বিভুজা বীণাপাণি প্রতিমা গত ১৫০ বছরের মধ্যেই কল্পিত হয়েছে।
দেবীর বাহন হংস, যা তিনি ব্রহ্মার শক্তি হিসাবে তাঁর কাছ থেকে লাভ করেন। বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সুর্য। সুর্যের সৃজনী শক্তির বিগ্রহ রূপ ব্রহ্মা এবং সুর্যাগ্নির গতিশীল কিরণ রূপ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব সরস্বতীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য।যথার্থ কারনেই। উপনিষদে হংস পরমাত্মার প্রতীক ; ‘ হংস’ ই তত্ত্বমসি জ্ঞান। কিন্তু পুরানে হংসবাহনা দেবীর উল্লেখ কম পাওয়া যায় । বরং দেখা যায় , দেবীর বাহন বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। মেষ , সিংহ, ময়ূরের কথাও পাওয়া যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মেষ বাহনা দেবীর মুর্তি আছে। দেবীর পূজার দিনে কোথাও কোথাও ভেড়া বলি এবং ভেড়ার লড়াই প্রচলিত ছিল একথা প্রসিদ্ধ গবেষক নলিনীকান্ত ভট্টশালী গবেষণায় পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে ময়ূরবাহনা দেবী মুর্তি দেখা যায়। কলকাতার যাদুঘরেও সিংহ বাহনা দেবী মুর্তি আছে। বেনারসের কাছে সরস্বতী মন্দিরে সিংহ বাহনা দেবী মুর্তি দেখা যায়। শতপথ ব্রাহ্মণ, জৈমনীয় ব্রাহ্মণ ছাড়াও কৃষ্ণযজুর্বেদে দেবীকে বারবার সিংহী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। সিংহী এবং মেষী যে দেবীর আদি বাহন ছিল তা বৈদিক গ্রন্থ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।
শুক্ল যজুর্বেদে দেবীসরস্বতী স্বয়ং ভিষক অর্থাৎ দেববৈদ্য। তাঁর রোগনিরাময় শক্তির কথা পরবর্তিকালেও প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। কথাসরিতসাগরে সোমদেব জানিয়েছেন যে পাটলিপুত্রের নাগরিকরা অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ওষুধ ব্যবহার করতেন। দেবীর সাথে যে চিকিৎসা শাস্ত্রের যোগ ছিল তা পুজোর উপকরণে বাসক ফুল,যবের শিষ, আমের মুকুল ব্যবহারে অনুমান করা যায়। যার গুরুত্ব আয়ুর্বেদে অপরিসীম।
দেবী সরস্বতী শুধু মাত্র হিন্দুধর্মেই নন ; বৌদ্ধ,জৈন্য ধর্মেও পূজিতা । এমনকি ভারতের বাইরে জাভা, চীন, জাপানে তাঁর পূজা প্রচলিত আছে। গ্রীক দেবী এথেনী, রোমানীয় দেবী মিনার্ভা প্রমুখদের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়।
এমন কি দেবী একসময় শাক্ত রূপে সুপরিচিত ছিলেন। পুরান অনুসারে তিনি বৃত্র নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন। তবে দেবীর এই শাক্ত রূপটি ক্রমশ চাপা পড়ে যায়। বরং সূক্ষ্ম কোমল অনুভূতি ও সৌন্দর্য তথা ললিতকলার দেবী হয়ে বিরাজ করতে থাকেন। আমাদের বিদ্যার দেবী হয়ে ওঠেন।
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তি, মধুসুদন দত্ত, থেকে বুদ্ধদেব বসু তাঁদের রচনায় বাগদেবীর বন্দনা করেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘মেঘমল্লার’ গল্পে দেবীর অপূর্ব রূপের কবিত্বময় বর্নণা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পুরস্কার’ কবিতায় দেবীর বন্দনায় বলেছেন –
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনি
বীণাগঞ্জিত মঞ্জুভাষিণী
কমল্কুঞ্জাসনা…
কুহেলী ব্যানার্জী
2 responses to “ সরস্বতী মহাভাগে”
অসাধারন লেখনী তোমার। অনেক তথ্য সম্মৃদ্ধ ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ দিদি। এভাবে সম্পুর্ণ লেখা পড়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।