//গ্রাম-বাংলার পথে প্রান্তরে ফোটা ফুলেদের কথা//


        আমাদের অনেকরই শখ বাগান করা। ফুল–ফলের গাছ লাগানো। নিজের বাড়ির বাগান, ছাদ বা ছোট্ট ব্যালকনি যেখানেই হোক না কেন কত শত নামি-দামি ফুলের গাছ আমরা লাগাই। ভারি ভারি তাদের সব নাম-ধাম। কিছু  ফুলের তো আবার নাম মনে রাখাটাই কখনো কখনো বড়ো কষ্টের হয়ে পড়ে । গালভরা নামের সে সব ফুলগাছগুলোকে কত যত্ন-আত্তি ও করতে হয়। কিন্তু পথে – প্রান্তরে অবহেলায় ফুটে থাকা যে সব ফুল আমাদের নজরে পড়ে তাদের নাম জানতে আমরা কিন্তু বিন্দুমাত্রও আগ্রহ দেখায় না। অথচ তাদের সৌন্দর্য সহজেই আমাদের নজরে পড়ে। তবুও তারা বড়ই অবহেলার। মাঠে-ঘাটে ফোটা নাম না জানা সেই সব ফুলগুলির ভেষজগুণ কিন্তু অপরিসীম। সে সব ফুলগুলোর মধ্যে কোন কোন ফুল আবার তার উজ্জ্বল উপস্থিতির কারনে বিদেশের বাগান , পার্কগুলিতেও স্থান পেয়েছে।

  নীলনিশিন্দা (Vitex trifolia, ইংরেজি নাম- Chinese chaste tree)- নিশিন্দা এক প্রকার ছোট পর্ণমোচী উদ্ভিদ। ঝোপঝাড় বিশিষ্ট হয়। কখন কখন উচ্চতায় দুই মিটারের বেশিও হয়ে থাকে। এই গাছের ফুল,ফল, পাতা, শিকড় সবকিছুই কাজে লাগে।  

    আয়ুর্বেদে স্মৃতিশক্তি বর্ধনে, অরুচি, হাঁপানি, কৃমি দূরীকরণে, চুলকানিতে এর ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়াও যখন এ দেশে যখন ন্যাপথলিন ছিল না  তখন দামি জামাকাপড় ও বই পোকার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিশিন্দার শুকনো পাতা ব্যবহার করা হত। মশা তাড়ানোর জন্য ধুনোর সাথে এই গাছের পাতা ব্যবহার করা হয়।

  অনন্তলতা (Antigonon leptopus,ইংরেজি নাম – Mexican creeper ) – অনন্তলতা গাছটি দ্রুত বর্ধনশীল আরোহণকারী লতা। অসংখ্য শক্ত আঁকশির মাধ্যমে অন্য গাছ বা মাধ্যমকে আঁকড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বসন্ত থেকে শরৎকাল পর্যন্ত এই ফুল দেখা যায়। গোলাপি এবং সাদা দুই প্রজাতির ফুল দেখা যায়। বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। দীর্ঘজীবী ও কন্দমুলধারী লতাটি অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু। বিরূপ আবহাওয়া বা অন্যকারনে গাছটি মরে গেলেও মাটির নীচে থাকা কন্দ থেকে আবার জন্ম নেয়। আগাছা হিসাবে পরিত্যক্ত বাড়ির প্রাচিরে ,বেড়ায় বেড়ে ওঠে। ফুল ফোটার প্রধান সময় গ্রীষ্মকাল। এই ফুলের রূপ সহজে ম্লান হয় না। এই গাছের বীজ পাখি ,হরিণ, ছাগল জাতীয় প্রাণীদের খাদ্য।

    নানারকম চিকিৎসায় বিভিন্ন দেশে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ঠাণ্ডাজনিত রোগে এর ব্যবহার দেখা যায়।

  ঝুন্ঝুনা, জুনজুনিয়া –   ( ইংরেজি নাম- Smooth Rattlepod ) স্থানীয় নাম – বন অতসী, শনফুল । মে থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ফুল ও ফল ধারণ করে। এর বীজ কখনো কখনো কফির পরিবর্তে ব্যবহার হয়ে থাকে।  আজকাল চা, রাবার ও নারকেল গাছের আচ্ছাদিত উদ্ভিদ হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি একটি বহুবর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ।  

  পোকামাকড়ের কামড় ও চর্ম রোগে এর ব্যবহার হয়।

  কলকাসুন্দা (Senna occidentalis) – এই গাছটি  রাস্তার ধারে , মাঠে – ঘাটে  প্রায় সর্বত্রই চোখে পড়ে। গাছটির উচ্চতা পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয় । কাণ্ডের রঙ গাঢ় সবুজ । ফুলগুলি সোনালী রঙের। ভাদ্র – আশ্বিনে ফুল ফোটে। ছোট ছোট ঝাড়ে চ্যাপ্টা শুটি তে বীজ থাকে। এর বীজগুলির স্বাদ তেতো। নেপাল, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জন্মে।

  হুপিং কাশিতে, গলা ভাঙা, মূর্ছা, হাঁপানি ইত্যাদি রোগে এই গাছের ব্যবহার করা হয়।

  মারহাটিটিগা, সূর্যকন্যা, বানগান্ডা (Acmella ciliate ,ইংরেজি নাম – Electric daisy ) – রাস্তার ধারে, দেয়াল ঘেঁষে, পুকুর পাড়ে এই গাছ জন্মে। পথের ধারে অবহেলায় ফুটে থাকলেও তৃণভোজী প্রাণীরা খায় না। খেলে মুখের ভেতরে চেতনা কাজ করে না। তাই তারা এড়িয়ে চলে।

     কাশি, দাঁত ব্যথা, শরীর ব্যথা,জিহ্বায় ঘা নিরাময় সহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে কার্যকরী। তবে শুধুমাত্র ওষুধ হিসাবে নয় মশলা প্রসাধনির কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশে এর পাতা স্যালাড হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

  বন মটমটিয়া (Chromolaena odorata)-সাধারনত নিচু জমি,পুকুর,খাল,বিলের পাশে জন্মে । ঝোপযুক্ত হয়। ডাল ভাঙলে তীব্র গন্ধ বের হয়। ফুল বেগুনী রঙের হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই এই গাছ দেখা যায়।

   এই গাছের পাতার রস পেটের ও নার্ভের টনিক হিসাবে ব্যবহার হয়।

   আশারিলতা, কালকেয়া (Capparis zeylanica ,) – বহুশাখা প্রশাখাযুক্ত ঝোপ জাতীয় শক্ত লতা। গ্রীষ্মকালে ফুল ফোটে। গায়ে শক্ত কাঁটা থাকে। শ্বাসকষ্টে, শরীর ফোলার রোগে , আগুনে পোড়ায়, দাদ ইত্যাদি রোগে উপকার পাওয়া যায়। এর সংস্কৃত নাম – ব্যাঘ্রনখী, হিন্দিতে – আরাডান্ডা। ফেব্রুয়ারী – এপ্রিল থেকে ফুল ফোটে। মূলত সাদা থেকে গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় ফুলগুলি গাঢ় বেগুনী রঙে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

  এই গাছের পাতা, পাকা ফল,মুল , মুলের ছাল  ইত্যাদি অংশ ব্যবহার হয়। এমন কি কাঁচা ফল আচারের জন্যও ব্যবহার হয়। কলেরা রোগ ছাড়াও মাথাব্যাথা , সর্দি , গলাবন্ধ , বমি ও ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য এই গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।  ভারত থেকে জাভা ,মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা , চিন, ফিলিপাইনে এই গাছ দেখতে পাওয়া    যায়।

  হলুদ আমরুল (Oxialis corniculata, Creeping woodsorrel) – ছোট ছোট হলুদ রঙের এই ফুলগুলি খুব সহজেই নজর কাড়ে। ভিজে ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় বেশী দেখা যায়। মাটিতে চাপা হয়ে লেগে থাকে। গাছটি লতানো হয়। এটিকে বাগানে বা কৃষিক্ষেত্রে আগাছা হিসাবে লাগানো হয়। আমরুলের পাতা ওষধি শাক হিসাবে খাওয়া হয়। এটিতে ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি সুতার মতো সরু ডাঁটায় তিনটি পাতা হয়। এর স্বাদ টক। অনেকে একে সুষনি শাক বলে ভুল করে।

    এই গাছের পাতা বিভিন্ন ওষধির কাজে লাগে। বাংলাদেশ ও ভারতে এই গাছ দেখা যায়।

   কাকমাচি (Solanum nigrum)-  কাকমাচি বা তিতবেগুন হল কাঁটাযুক্ত ছোট গাছ। গাছটি ফসলের সাথে জন্মালে তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয়। এই গাছের পাতা পাঁচ মিশালি শাক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।  জ্বর, হাঁপানি, চর্মরোগে, জন্ডিসে এই গাছকে ব্যবহার করা হয়।

   আঁকর কাঁটা (Alangium salvifolium ,Sage leaved Alangium) –এটি একটি ওষধি গাছ। বসন্তে সারা গাছ সাদা রঙের ফুলে ছেয়ে থাকে। এসময় পাতা থাকে না। এরপর ধীরে ধীরে পাতা গজালে ফুল কমতে থাকে । ফুল থেকে মার্বেলের মতো ফল হয়। গ্রীষ্মে ফলগুলো পেকে  লাল হয়ে যায়। পাকা ফলগুলো খাওয়া যায়। দাঁতের মাড়ি ফুলে গেলে অথবা মুখে ঘা হলে এই গাছের শিকড়ের ছাল অনেক কাজে দেয়।

   ত্রিধারা (Tridax procumbens) – ডেইজি  পরিবারভুক্ত সপুষ্পক উদ্ভিদ। বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক উদ্ভিদ হিসাবে পরিচিত । রাস্তায় পথে – ঘাটে  প্রায় সর্বত্রই ফুটে থাকতে দেখা যায়।

  পুটুস (Lantana camera) – এই ফুল নানা রঙের দেখতে পাওয়া যায়। তবে গোলাপি রঙের বেশী দেখতে পাওয়া যায়। রাস্তায় পথে ঘাটে এই গাছ খুব সহজেই বেড়ে ওঠে।

সমগ্র এশিয়া জুড়েই এর উপস্থিতি। ত্বকের চুলকানি , কুষ্ঠরোগ ,হাম , আলসার সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

  শিয়াল কাঁটা (Argemone mexicana) – কাঁটাযুক্ত পপি জাতীয় গাছ। আগাছা এবং বিষাক্ত জাতীয় গুল্ম। তবে এই গাছের রস চোখের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হত। এই গাছের বীজ অনেকটা সর্ষের মতো দেখতে।

  লাল ভেরেন্ডা (Jatropha gossyphiifolia) – বেগুনী রঙের পাতা বিশিষ্ট হয়। লাল ছোট ছোট ফুল হয়। আগাছা জাতীয় , এর পাতা বিষাক্ত । তৃণভোজীরাও খায় না। তবে এর কিছু ওষধি ব্যবহার আছে।

  মাটি কন্দুরি (Alternanthera sessilist ) – এটি একটি আগাছা উদ্ভিদ। বহুবর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ। ভিজে জলা জায়গায় জন্মায়। ফুলগুলি খুব ছোট আর গোলাকার। আগাছা হলেও কোন কোন অঞ্চলের মানুষ একে সবজি হিসাবে খায়। এছাড়া ভেষজ ওষুধেও এর ব্যবহার আছে।

  ঘেঁটু ( Clerondendrum infortunatum ) –  এর সংস্কৃত নাম ঘণ্টাকর্ণ । সাধারণত মাঠে – ঘাটে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। বসন্তে এই ফুল থোকায় থোকায় ফোটে। গবাদি পশুর রোগ নিরাময়েও ব্যবহার হয়। গ্রামাঞ্চলে একে ভাঁট ফুল ও বলা হয়। এই ফুল মহাদেবের পূজার কাজে  ব্যবহার করা হয়।

                                                        Kuhali Bandyopadhyay