মোগাম্বো খুশ হুয়া


   কুহেলী ব্যানার্জী

           

  সকাল থেকে মেজাজটা বিশেষ ভালো নেই মোগাম্বোর। ও পাড়ার বাদশা এসে ওকে বেশ করে শাসিয়ে গেছে। এই নিয়ে দুবার হয়ে গেল ওরই এলাকায় এসে ওকেই শাসানি দিয়ে যাওয়াটা মোগাম্বো একেবারেই মেনে নিতে পারছে না।      

     কারবালার বেশ নামকরা ষণ্ডাগুন্ডা হুলো বাদশা। চেহারা খানাও শাহি। দেখতে মিশমিশে কালো, ঘাড়ে-গর্দানে পুরো এক, থ্যাবড়া মুখখানা যেন একটা বড় জাবদা বাটির সমান। বাগানের ভাঙ্গা প্রাচীর ধরে যখন ইয়ামোটা লেজটি তুলে সে হেঁটে যায় তখন যে কোন রাজা-বাদশা তার কাছে ফেল মেরে যাবে। গলাখানাও ঠিক তেমনি রাসভারি। একবারটি ম্যাও করলে গোটা তল্লাটেই জানান পড়ে যায় বাদশার আগমনের। পাড়ার কুকুরগুলো পর্যন্ত বাদশাকে রীতিমতো সমীহ করে চলে। কোন ট্যাঁ ফোঁ করে না। চুপটি করে লেজ নামিয়ে বসে থাকে নয়তো কুঁই কুঁই শব্দে সরে পড়ে। 

         এইতো সেদিন গোরস্থানের এর ভেতরটা একটু টহল দিতে গেছে এমন সময় এক বেজির সাথে সাক্ষাৎ। ব্যাস এরপর দুজনের ধুন্ধুমার লড়াইয়ে এলাকাটা মুহূর্তেই সরগরম হয়ে উঠলো। বেশ কয়েকটা নেউল ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে বাদশাকে দেখলেও কেউ এগোবার এতটুকু সাহস দেখাতে পারেনি। মোগাম্বো সবই শোনে। খবরিওয়ালা ঘন্টিলাল সময়ে অসময়ে এসে তাকে পাড়ার লেটেস্ট নিউজগুলো দিয়ে যায়।

( ২)

          

পুকুরপাড়ের ধারে বেল আর শেওড়া গাছের তলায় যেখানে ধর্মরাজ-মনসা-শিব সব ঠাকুরের মূর্তি রয়েছে সেখানেই আজকের মিটিং বসেছে তাদের। বেঞ্চের হাতলে বসে পায়ের উপর পা রেখে লেজটাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে মোগাম্বো। স্ট্র হাতে ফ্রূটিতে একটা করে চুমুক দিচ্ছে আর তার মতামত জানাচ্ছে নানা বিষয়ে। পাশে ঘন্টিলাল, সিতারা, চমচম, বিজলী সবাই বসে আছে। জোরদার কথাবার্তা চলছে। বাদশা কে নিয়ে সকলেই কমবেশি চিন্তিত। পাড়ায় মস্তানি তার দিনদিন বেড়েই চলেছে। এমনকি মোগাম্বোর মতো ঘরের মার্জারদের প্রতিও তার মস্তানি ইদানিং বেড়েই গেছে।    

  

        মোগাম্বোর ব্যাপার-স্যাপারটা অবশ্য একটু আলাদা। অন্য সকলে যেখানে দুধটা, ফেলা ভাতটা খেয়ে দিন কাটিয়ে দেয় সেখানে তার জন্য নিত্য নতুন মাছ, চিংড়ি, মাছের ডিম নয়তো মাংসের কিমা আসতেই আছে। দুধ তো সে মুখেই তোলে না। এতদিন ছোটটি ছিল তাই বাড়ির বাইরে তাকে কেউ ছাড়তো না। কিন্তু সেদিন চুপিচুপি হাউজিংটা সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ পুকুরধার ঘেঁষে নিমগাছের তলাটাই বসেছিল। টলটলে পরিষ্কার জলে জ্যান্ত মাছগুলো বেশ খেলে বেড়াচ্ছে। পিছনের খেলার মাঠটায় বিকেলে যখন ছেলেপুলেগুলো ক্রিকেট কিংবা ফুটবল নিয়ে হুটোপুটি করে মোগাম্বো তখন বারান্দায় বসে তাদের কর্মকাণ্ড দেখে।

         আজ মাঠটাতে সে এই প্রথম এলো। সুন্দর রোদ উঠেছে। ঘাস ফুলের মাঝে ছোট্ট প্রজাপতিরা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। মোগাম্বো কটাকে ধরার নিষ্ফল প্রয়াস করে শেষে ঘাসের ওপর শরীরটাকে এলিয়ে দিল। তারপর বারকয়েক গড়াগড়ি খেয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। একটু ঘুরেফিরে তার মনটা আজ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে।    

     

         না বাড়িতে ওকে কেউ তেমন কিছু বলেনি। মারও পড়েনি। বরং উল্টে সকলে কোথায় গেছিলি বলে  চেঁচামেচি আর কান্না জুড়ে দেয়। তারপর  বাটি ভরতি ওর পছন্দের খাবার খেয়ে জম্পেশ করে ঘুম দেয়।

         বাড়িতে ও তো পুরো আদরের দুলাল। সত্যি কেনই বা তাকে সকলে হিংসে করবে না বিড়াল হয়েও সে যে এতটা আদর-ভালবাসা পেয়ে থাকে তা বোধহয় অন্য কোন বাড়ির মেনিগুলো পায় না। তাইতো বাদশার এত হিংসে। নানারকম ফন্দি-ফিকির বার করে প্রায়দিনই ওকে বিড়াল সমাজে হেনস্থা করে থাকে। ওর একটা সেলফ রেসপেক্ট বলে কিছু আছে তো নাকি। আর বাদশা যতই ষণ্ডামার্কা হোক না কেন ওর মতো হ্যান্ডসাম তো নয়। এই এলাকাতেও কেউ আছে কিনা অবশ্য সন্দেহ। জেলাসি ফিল করার মতো সত্যি যথেষ্ট কারনও আছে।

                                               (৩)

        ভেটকি মাছ ভাজার সাথে গরম গরম ভাত খেয়ে সবে আড়িমুরি ছাড়ছে এমন সময় গলায় কি একটা পরিয়ে দিল বাড়ির ছোট্ট ছেলে সানু। ওর সাথে ইদানিং বেশ বন্ধুত্ব জমে উঠেছে তার। সকাল-বিকেল বেড়াতে নিয়ে যায়, খেতে দেয়, শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করায়। আজও নিয়ে গেল স্নান করাতে কিন্তু মোগাম্বোর মুডটা ঠিক ভালো নেই। বাদশা নাকি সিতারার দুধের বাটিটা পুরোটা সাবার করে দিয়ে গেছে। আবার যাবার সময় সে আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে তার শাহি হাসিখানা দিয়ে বলেও গেছে যে ‘জোর যার মুলুক তার’। সিতারা সেই থেকে কাঁদছে।ঘন্টিলাল এসে এইমাত্র খবরটা দিয়ে গেল।

            এদিকে শরীরটা আজ তার সকাল থেকেই ম্যাচ্ম্যাচ্ করছে, গলাটাও কেমন জানি খুশ খুশ করছিল সেই ভোর থেকে। বারদুয়েক  হাঁচি হয়ে গেল। স্নানের পর সানু গা মুছিয়ে যত্নের সাথে পরিপাটি করে লোমগুলো আছড়ে দিল। কিন্তু মোগাম্বো যেই ম্যাও বলতে যাবে অমনি দেখে কেমন একটা ভারিক্কি আওয়াজ গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো। চমকে গেল মুহূর্তের জন্য। পাশে শুকোতে দেওয়া কারিপাতার বাটিটা ছিটকে পড়ল । নিজের চিরপরিচিত গলাটা কেমন যেন অচেনা ঠেকলো। ভাবলো কেমন একটা অন্যরকম আওয়াজ এলো না ! এদিকে বাড়ির সকলে তখন যে যেখানে ছিল  ছুটোছুটি-দাপাদাপি শুরু করেছে। ব্যাপারটা ঠিকমতো ঠাওর করতে না পেরে বার কয়েক ম্যাও ডাকতে গিয়ে দেখলো আওয়াজটা ঠিক ম্যাও এর মতো শোনাচ্ছে না। এ বাব্বা! কি করে হলো এমনটা। ঠাণ্ডা লেগে ? না তাতো হওয়ার নয়। এমনতর ঠাণ্ডা তো আগেও লেগেছে। তবে কি সানুর পরানো বেল্টের জন্যই হল? এমন সময় চারদিক থেকে  চিৎকার শোনা  গেল – বাঘ বাঘ।

          আশপাশটা একটু দেখে নিল মোগাম্বো। তারপর বারকয়েক হালুম হালুম ডেকে নিয়ে হুলোটাকে জব্দ করার বেশ একটা রাস্তা পেয়ে  নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রায় মগ্ন হলো। খুশি হয়ে মনে মনে বলে উঠলো ‘মোগাম্বো খুশ হুয়া’।

                                                                        (ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *