কুহেলী ব্যানার্জী
মোগাম্বো খুশ হুয়া(পর্ব -৩)
‘’ চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে
উছলে পড়ে আলো……’’
সুরেলা কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতটা সবে ধরেছে মোগাম্বো। পাশ থেকে খিক্ খিক্ করে হেসে উঠলো কচুরি ( পাড়ায় সে গুটকে কচুরি নামে প্রসিদ্ধ )। মেজাজটা বেশ বিগড়ে গেল মোগাম্বোর। দিলো থাবা দিয়ে ঘা কতক, ব্যাটা পাশে বসে সেই থেকে ম্যালা ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করছিল। কচুরিটা শেষমেশ ম্যাও ম্যাও করে পালালো। আজ গুরু পূর্ণিমা। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র বিরাজ করছে। জোছনার আলোয় পথ-ঘাট যেন মায়াবী রূপোর রং মেখেছে। ঝোপে-ঝাড়ে জোনাকিরা ঝিকিমিকি আলো জ্বালিয়েছে। মন কেমন করা বাতাসে জুঁইফুলের মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। মাঝেমধ্যেই আবার ভাসা মেঘেদের আড়ালে চাঁদ লুকোচুরি খেলছে। পাঁচিরের একটা কোণে বসে আছে সে। মনটা বেশ ফুরফুর করছিল। এমন একটা মনোরম পরিবেশে কিছুক্ষণ থেকেই ওর একটু গান গান মন করছিল । কচুরি ব্যাটা আজ কেসটা একেবারে কেঁচিয়ে দিয়ে গেল। ব্যাটা গানের মাধুর্যের কিছু বোঝে নাকি? আসলে হয়েছে কি , মাঝে মাঝে মোগাম্বোর মধ্যে বেশ একটা গায়ক সত্তা ফুটে ওঠে। চমচম তার এসব বিষয়ে একনিষ্ঠ ভক্ত বা শ্রোতা বলা যেতে পারে। অবশ্য গানটাও সে মন্দ গাই না। তাই কখনোসখনো চমচমের সাথে তার আরও দু-একজন শ্রোতাও জুটে যায়। তবে আজ আর সেটা হলো না দেখে মোগাম্বো নিজের মনেই গান ধরল।
‘’ও চাঁদ সামনে রেখো জোছোনাকে
কারো নজর লাগতে পারে…..’’।
কে যেন পাশ থেকে বলে উঠলো, ধুর ! জোছনাকে কি সামলাবো রে ব্যাটা? ও তো আমারই বড় বালাই। রোজ রাতে আকাশে ওঠো আর সারারাত জেগে চুপ করে বসে থাকো। কার এমন ধারা কাজ ভালো লাগে বলতো? মোগাম্বো চমকে যায়। চেয়ে দেখে আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে এই এত্ত কাছে। ব্যাপারটা ওর কাছে একেবারেই অবিশ্বাস্য ! কিছুক্ষন অবাক চোখে চেয়ে রয় । কি আশ্চর্য ! চাঁদটা আবার তার সঙ্গে কথাও বলছে। এতো কাছে চলে আসাতে তার রূপালী আলোর ছটায় মাঠঘাট, পুকুর-বিল সব ভেসে যেতে থাকলো।
চাঁদটা আবার কথা কয়। মোগাম্বোকে বলে , কি মুশকিল বলতো পৃথিবীর মানুষগুলোর কি খেয়ে-দেয়ে কাজ কম্ম নেই যে আমাকে নিয়ে নিত্যনতুন গান আর কবিতা লেখে । রোজ রোজ এত আদিখ্যেতা আমার পোষায় না বাবা ! আমি মরছি আমার জ্বালায় আর আমাকে নিয়ে কি না এত কাব্য রচনা ! কার ভালো লাগে বলতো ? এই যে দুদিন আগে আমার বুকে কি সব যন্ত্রপাতি পাঠাল আমি কি তার বেলা কিছু বলেছি নাকি ! তা আমি যদি মানুষজনের কিছু কাজে লাগতে পারি সে তো ভালোই ! আমার নিজেরও আনন্দই হবে। কিন্তু এসব নিয়েও আবার যে কাব্যি লেখা শুরু হয়েছে তা আমার মোটেও পছন্দ নয় বাপু । এই বলে চাঁদ একটু থামল।
আশেপাশের স্নিগ্ধ-শীতল বাতাসটা ধীরে ধীরে কেমন যেন ভারি হয়ে উঠল । চালতা গাছের ডালে বসে থাকা পাখিটা ডানা ঝাপটাতে থাকল। মোগাম্বো অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এমন এক গুরুতর বিষয়ে তার মতো নিরীহ মার্জারের কথা বলাটা ঠিক কতটা যুক্তিসঙ্গত সে ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু এবার চাঁদ যখন সরাসরি জিজ্ঞেস করেই ফেলল তখন আর তার বলতে আপত্তি কোথায় ? সে বলল, কেন এ তো বড়ো আনন্দের কথা । কত মান্যি-গুণ্যিরা তোমাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান লেখেন । তোমার তো তারা সুখ্যাতিই করেন গো। সে তো বেশ ভালো ব্যাপার !
চাঁদ বলে ধুত্ ত্যারি ! লেখে লিখুক না। কে মানা করেছে ? কিন্তু তাই বলে কখনো আমাকে ” মামা ” বানাচ্ছে তো কখনো আবার “ও চাঁদ” বলে গার্লফ্রেন্ড বানাচ্ছে ; আমি যে জেন্ডার ক্রাইসিসে ভুগ্ছি ভাই। আমার অস্তিত্ব আজ বড়ই বিপন্ন। এই নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি। এই তো কিছুক্ষণ আগেই সূর্যদার সাথে দেখা করে এলাম। দূর থেকেই হাই-হ্যালোটা সেরে ফেলতে হলো। এবার গরমকালটায় তো তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে পারে নি। ওই বেশ ভালো । সকলে কেমনটি জব্দ। এমন তার চন্ডালের মত তেজ যে সবাইকেই রীতিমতো তাকে সমঝে-বুঝে চলতে হয়। আর আমাকে দেখো……যতো বেশি মনোরম আলো ( তোমাদের ভাষায় ) ছড়ায় তত বেশি আমাকে নিয়ে তোমরা গালগল্প জুড়ে দাও। এই তো কি এক চড়কা কাটা চাঁদের বুড়ির কথা আছে নাকি শুনছি। তোমরা আবার তাকে নিয়েও কি সব গল্প ফেঁদে রেখেছো । মোগাম্বো হাঁইহাঁই করে ওঠে । বলে হ্যাঁ তাই তো পাশের বাড়ির পুচকেটা কে তার মা কি একটা এরকমই গল্প শোনাচ্ছিল বটে ! বেশকিছুদিন থেকে রাতের খাওয়া – দাওয়াটা সেরে মোগাম্বো পাঁচিরের ধারটাতে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে আসে। আর সেই সুবাদে তখনই ওই পুচকেটার সাথে তারও বেশ গল্প শোনা হয়। গল্প শুনতে সে ও তো ভালই বাসে ।
চাঁদের রাগটা আরো বেড়ে গেলো। হ্যাঁ নিজে তো বেশ খাও-দাও, আরাম করে ঘুম দাও। আর মাসে পনেরোদিন এক নাগাড়ে আলো দিতে হচ্ছে আমাকে। আমার কি লাভ আছে শুনি ! কেমন তুমি খুশি মনে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প জোড়ো, আবার এই তো কদিন আগে দেখলাম বেশ খানিকটা মারপিটও করে নিলে তোমার জাত ভাইদের সাথে। এদিকে আমাকে দেখো, না আছে কথা বলার কেউ; না আছে সঙ্গীসাথী। একলা একলা বছরের পর বছর শুধু নিজের কাজটি করে চলো। একই পথে ঘুরে চলো। এ কেমনতর নিয়ম বলি ! সত্যি, আমাদের কথা ভাববেটাই বা কে? কারো অতো সময়ও নেই, মাথাব্যথাও নেই। সূর্যদার অবশ্য এসব নিয়ে কোন মন্তব্য নেই। কিন্তু তাই বলে আমাকেও কি সূর্যদার মতই হতে হবে এমন তো মানে নেই !
মোগাম্বো তো একটা বিড়াল। সে বেচারা এত কিছু বোঝেসোঝে না। চুপ করে চাঁদের কথা শুনতে থাকে। এমন সময় ওপাশ থেকে আয় আয় চাঁদ মামা টি দিয়ে যা ….. বলতে বলতে পুচকের মা বাইরে উঠোনে বের হয়।
ওই দেখো আবার শুরু হলো ! —– এই বলে হুশ করে চাঁদ আবার আকাশে ফিরে যায়। সমস্ত অভাব-অভিযোগ সত্বেও সে আবার নিজের রোজকার কাজে লেগে পড়ে। নিঝু্ম্ থম্থমে পরিবেশটা কেটে গিয়ে তখন চারদিকটা আবার আগের মতই ঝলমলিয়ে ওঠে ।
****************************************************
পাঁচিরের গায়ে শরীরটাকে খানিক এলিয়ে দিয়ে ল্যাজটা দোলাতে দোলাতে মোগাম্বো ভাবতে থাকে, চাঁদের সাথে তার আজ কথা না হলে এতকিছু কি সে আদৌ জানতে পারত ? সানু যখন পড়তে বসে তখন চুপটি করে তার পড়াগুলো সে শোনে ঠিকই। কিন্তু ও তো বই এর কথা; সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, জোয়ার-ভাটার কথা । কিন্তু আজ যেটা শুনলো সেটা তো বই বা অন্য কারো কথা নয়, এ যে একান্তই চাঁদের মনের কথা । যা সে একমাত্র তার সাথেই শেয়ার করলো। বেশ খুশি খুশি লাগছিল মোগাম্বোর। তবুও সে কেন না জানি বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল ।
*****************************************************
‘’এই মায়াবী চাঁদের রাতে…..
হাতে হাত………।’’
গানটা গাইতে গিয়েও কি একটা মনে করে চুপ করে গেল মোগাম্বো। মনে মনে বেশ খানিকটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছিল সে। কাল একটা মিটিং না ডাকলেই চলছে না। আসলে চাঁদের ব্যাপারটা মোগাম্বোর মনে বেশ দাগ কেটেছে। সত্যি, ব্যাপারটা তো কখনো সে এভাবে ভেবেই দেখেনি। এতকাল সে মানুষ আর বিড়ালের মতোই ভাবনা-চিন্তা করেছে । কিন্তু এবারে চাঁদের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর সে অন্য একটা জগতের সন্ধান পেল। তাই চাঁদের কথাগুলোর বিষয়ে তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতেই হচ্ছে। রাত ক্রমশ বাড়তে থাকে। মোগাম্বোর ঘুম পায়।
শরীরটাকে বেশ খানিকটা টেনে নিয়ে, লেজটি তুলে শিস দিতে দিতে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
( ক্রমশ )